'ভুল বোঝাবুঝি' অবসানে

ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান টিউলিপ

New-Project-2025-06-08T171654.139.png

ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন লন্ডন সফরকালে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সাবেক ব্রিটিশ এমপি এবং বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক। দুর্নীতির অভিযোগে সৃষ্ট ‘ভুল বোঝাবুঝি’ নিরসনই তার এই সাক্ষাতের মূল উদ্দেশ্য বলে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডনে রাজা চার্লস এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়্যার স্টারমারের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করবেন। এই সফরের আগে ড. ইউনূসকে একটি চিঠি দিয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক, যেখানে তিনি আলোচনার সুযোগ চেয়েছেন।

চিঠিতে টিউলিপ উল্লেখ করেছেন, “বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যিনি আমার খালা, তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ও জড়িত থাকার বিষয়ে আমাকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে—দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযোগ থেকে এই যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে তা এই সাক্ষাৎ দূর করতে পারবে বলে আমি আশা করি।”

টিউলিপ সিদ্দিক তার চিঠিতে নিজের পরিচয় তুলে ধরে লিখেছেন, “আমি একজন যুক্তরাজ্যের নাগরিক। আমার জন্ম লন্ডনে এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গত এক দশক ধরে হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেটের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমার হৃদয়ের টান রয়েছে কিন্তু সেখানে আমার কোনো সম্পত্তি বা ব্যবসায়িক স্বার্থ নেই। আমি ওই দেশে জন্মাইনি, থাকি না, এমনকি আমার পেশাগত জীবনও গড়ে উঠেনি সেখানে।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি ও ব্যবসা থেকে তার দূরত্ব বোঝাতে চেয়েছেন।

টিউলিপ দাবি করেছেন, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে না। তিনি বলেন, “দুদককে আমি এ বিষয়ে পরিষ্কার করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তারা লন্ডনে আমার আইনজীবীদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগে আগ্রহ দেখায়নি। বরং তারা বারবার ঢাকার একটি ঠিকানায় এলোমেলোভাবে চিঠিপত্র পাঠাচ্ছে।”

তিনি আরও অভিযোগ করেন, “এই কাল্পনিক তদন্তের প্রতিটি ধাপ গণমাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ আমার আইনি দলের সঙ্গে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করা হয়নি।” এই ধরনের গণমাধ্যম ভিত্তিক প্রচার তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে বলেও তিনি মনে করেন।

ড. ইউনূসের প্রতি লেখা চিঠিতে টিউলিপ সিদ্দিক তার নির্বাচনী এলাকার জনগণ এবং দেশের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে এসব প্রতিবেদন যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়, তা নিশ্চিত করার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তার দাবি, তিনি তার খালার বিরোধীদের পরিচালিত একটি “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কুৎসা অভিযানের” লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন।

উল্লেখ্য, দুর্নীতির অভিযোগের জেরে টিউলিপ সিদ্দিককে সম্প্রতি ব্রিটিশ মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছে। অভিযোগ উঠেছিল যে, বাংলাদেশের সাবেক সরকারের আমলে টিউলিপ সিদ্দিক ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা সরকারি অবকাঠামো খাত থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন কি না—এ অভিযোগের তদন্ত করছে দুদক। এই অভিযোগের সূত্রপাত করেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ।

দুদক এবং একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, টিউলিপ সিদ্দিক বা তার মা শেখ রেহানা “ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে” ৭ হাজার ২০০ বর্গফুট আয়তনের একটি জমি দখলে নিয়েছেন। যদিও টিউলিপ সিদ্দিক এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার আইনজীবীরা এসব অভিযোগকে “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” ও “ভিত্তিহীন” বলে দাবি করেছেন।

গত মাসে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তবে টিউলিপ জানিয়েছেন, এমন কোনো পরোয়ানা বা আদালতে হাজিরার আদেশ সম্পর্কে তার জানা নেই।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ ‘২ বি’ প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতাভুক্ত দেশ। এই চুক্তির অধীনে, যুক্তরাজ্যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে বাংলাদেশ থেকে সুস্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দেখাতে হয়—যা মন্ত্রী বা বিচারক পর্যায়ে যাচাই করে অনুমোদন দিতে হয়।

গত বছর যুক্তরাজ্যে সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত অভিযোগ ওঠার পর টিউলিপ নিজেই ব্রিটিশ মন্ত্রীদের আচরণবিধি তদারক কর্মকর্তা লরি ম্যাগনাসের কাছে রিপোর্ট করেন। টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন। ম্যাগনাস জানান, তদন্তে তিনি কোনো প্রমাণ পাননি যে টিউলিপের সম্পদ অবৈধভাবে অর্জিত। তবে তিনি মত দেন, টিউলিপের উচিত ছিল—বাংলাদেশে তার পারিবারিক সম্পৃক্ততা থেকে উদ্ভূত ভাবমূর্তির ঝুঁকির বিষয়ে আরও সতর্ক থাকা।

তদন্তে আরেকটি বিষয় খতিয়ে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে মস্কোতে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি পারমাণবিক চুক্তির সময় টিউলিপ সিদ্দিকের উপস্থিতি। এই চুক্তি ঘিরে গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। তবে টিউলিপ জানান, তিনি তখন মস্কোতে পর্যটক হিসেবে অবস্থান করছিলেন। তার এই ব্যাখ্যা যুক্তিযুক্ত মনে করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

তবুও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইকোনমিক সেক্রেটারি ও সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন টিউলিপ। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, এসব বিতর্ক কিয়্যার স্টারমারের নতুন সরকারের জন্য ‘বিভ্রান্তি’ তৈরি করছে।

Leave a Reply

scroll to top