ক্রিকেট বিশ্বের এক অনন্য তারকা, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। অবিশ্বাস্য সব ইনিংসের রচয়িতা, ক্রিকেটের রঙিন জগতের এক জাদুকর গ্লেন ম্যাক্সওয়েল অবশেষে ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন। ৩৬ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডার তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন এমন এক মুহূর্তে যখন তিনি অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে নিজের নাম সোনার অক্ষরে লিখে ফেলেছেন। এখন থেকে শুধুমাত্র টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেই অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করবেন তিনি। এবং ২০২৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন এই তারাকা ক্রিকেটার।
ম্যাক্সওয়েলের এই সিদ্ধান্ত এসেছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অস্ট্রেলিয়ার সেমিফাইনাল থেকে বিদায়ের পরপরই। দীর্ঘদিন ধরে শরীরের ওপর চলতে থাকা চাপ ও ২০২২ সালে তার পায়ে ভয়াবহ চোট—এইসব মিলিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছেন, এখন সময় হয়েছে নতুন প্রজন্মের হাতে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার।
দলের বোঝা হতে চান না ম্যাক্সওয়েল
“আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার শরীর আর আগের মতো সাড়া দিচ্ছে না। আমি চাই না দলের জন্য বোঝা হয়ে থাকি,” এক আবেগঘন সাক্ষাৎকারে ‘ফাইনাল ওয়ার্ড’ পডকাস্টে বলেন ম্যাক্সওয়েল। “আমি নির্বাচক জর্জ বেইলির সঙ্গে কথা বলেছি। বলেছি, ২০২৭ বিশ্বকাপ আমি দেখছি না। এখনই সময় নতুনদের প্রস্তুত করার।”
১৪৯টি ম্যাচে ৩৯৯০ রান, স্ট্রাইক রেট ১২৬.৭০—সংখ্যা দিয়ে ম্যাক্সওয়েলের প্রভাব বোঝানো কঠিন। কারণ তিনি ছিলেন একজন শিল্পী, যার ব্যাট থেকে বের হতো ক্রিকেটের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত শটগুলো। ২০২৩ বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তার ২০১ রানের ইনিংসটি হয়তো ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর ইনিংস। অস্ট্রেলিয়া যখন ৯১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে, তখন একাই দলকে জয় এনে দেন তিনি। এটিই ছিল প্রথমবারের মতো কোনো ব্যাটারের চেজ করতে নেমে দ্বিশতক, তাও ছয়ে নামা একজনের!
“এই ইনিংসটাই আমার ক্রিকেট জীবনের সেরা মুহূর্ত। যেন নিজেকে দুনিয়ার সামনে উজাড় করে দিয়েছি,” বলেন ম্যাক্সওয়েল।
তিনি আরও তিনটি সেঞ্চুরি করেছেন ওয়ানডেতে, যার প্রতিটিই এসেছিল দলের সঙ্কটের সময়ে। ২০২০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০৩ রান তাড়া করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া যখন ৭৩-৫, সেখান থেকে তিনি ও অ্যালেক্স কেরির ২১২ রানের জুটি অজিদের এনে দেয় এক অবিশ্বাস্য জয়। ম্যাক্সওয়েল সেই ম্যাচটিকেই তার ‘সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি’ বলেছেন।
বল হাতেও ছিলেন দুর্দান্ত
বল হাতেও ম্যাক্সওয়েলের অবদান অবিস্মরণীয়। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে প্রধান স্পিনার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ২০২৩ সালের বিশ্বকাপেও বল হাতে নিয়ন্ত্রিত বোলিং করে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উইকেট নিয়েছেন—বিশেষ করে ফাইনালে রোহিত শর্মাকে আউট করে ভারতের ওপর চাপ তৈরি করেছিলেন। ২০১৪ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে মাত্র ২ রান ডিফেন্ড করতে নেমে শেষ ওভারে ডাবল উইকেট মেডেন করে দলকে জিতিয়ে দেন—এটি এখনও ক্রিকেট ইতিহাসে এক বিরল কীর্তি।
মাঠে তার উপস্থিতি মানেই প্রাণচাঞ্চল্য—চোখধাঁধানো ফিল্ডিং, দলকে উজ্জীবিত করার ক্ষমতা, এবং সবসময় হাসিমুখে লড়াই করার মানসিকতা। অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচক জর্জ বেইলি বলেন, “ওর মতো প্রাকৃতিক প্রতিভা খুব কমই দেখা যায়। দলের প্রতি তার ভালোবাসা ও নিবেদন ছিল অতুলনীয়।”
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সিইও টড গ্রিনবার্গ বলেন, “ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে ম্যাক্সওয়েল ছিলেন সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও প্রভাবশালী ব্যাটারদের একজন। তার ব্যাটিং স্টাইল অনুপ্রাণিত করেছে হাজার হাজার শিশু-কিশোরকে।”
বর্তমানে আঙুলের চোট থেকে সেরে উঠছেন ম্যাক্সওয়েল, তবে শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে মেজর লিগ ক্রিকেটে খেলতে ফিরবেন এবং ২০ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া ক্যারিবিয়ান সফরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেও অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ওয়ানডে ক্রিকেট বিদায় বললেও গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ক্রিকেট গল্প এখনও শেষ হয়নি। আমাদের স্মৃতির অ্যালবামে তিনি চিরকাল থাকবেন সেই লড়াকু, সৃষ্টিশীল আর সাহসী ক্রিকেটারের রূপে—যিনি ব্যাট হাতে যেনো কবিতা লেখেন, আর মাঠে নামলে তৈরি করেন একের পর এক মঞ্চনাটকের রোমাঞ্চ।