বাংলাদেশের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’-এ দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। নিজের ভ্যারিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক বিস্ফোরক পোস্টে তিনি জানিয়েছেন, তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আতিক মোর্শেদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও স্বার্থের সংঘাত (conflict of interest) সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি নিজেই।
ফয়েজ তৈয়্যব বলেন, “আমার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি তদন্তের ব্যবস্থা করেছি, নির্দেশনা দিয়েছি।” একইসঙ্গে তিনি দাবি করেন, নগদের ভারপ্রাপ্ত সিইও এ বিষয়ে প্রেস রিলিজ দেবেন। তবে তিনি তীব্র ভাষায় অভিযোগ করেন, “এখানে অন্যায়ভাবে সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং আমাকে টেনে আনা হয়েছে।”
ফয়েজ তৈয়্যব একাধিক অনিয়মের তালিকা প্রকাশ করেছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী,
ভুয়া ই-কেওয়াইসি (ইলেকট্রনিক কাস্টমার ভেরিফিকেশন, ই-কেওয়াইসি ছাড়া একাউন্ট খোলা, ভুয়া এজেন্ট নিয়োগ, ভুয়া ক্যাশব্যাক, অবৈধ মার্চেন্ট একাউন্টের মাধ্যমে, লেনদেন। এসব কৌশলে আগের সরকার ঘনিষ্ঠ চক্র নগদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। তিনি জানান, ডাক বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই দুর্নীতির পরিমাণ ৬৪৫ কোটি টাকা।
ফয়েজের বক্তব্যে পরিষ্কার, নগদকে নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ডাক বিভাগের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক একতরফাভাবে কেপিএমজিকে দিয়ে ফরেনসিক রিপোর্ট করাচ্ছে, যেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার অভিযোগ তোলেন তিনি। তাঁর মতে, এই কাজের জন্য সিসিএ কিংবা সিআইডির ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবই যথেষ্ট ছিল।
ফয়েজ লিখেছেন, “একটা রেগুলেটর তীব্র প্রতিযোগিতা পূর্ণ পরিবেশে একটা কোম্পানির অপারেশন এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেশন করলে প্রতিযোগীর সুবিধা হয়, সে মনোপলি হয়ে যায়।”
সাবেক সাংবাদিক ফয়েজ তৈয়্যব এ প্রসঙ্গে মানবজমিন পত্রিকার নাম উল্লেখ করে বলেন, “তারা সুকৌশলে এই দায় আমার আর নাহিদ ইসলামের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে।” তিনি উল্লেখ করেন, পত্রিকাটিতে তিনি এক ডজনেরও বেশি কলাম লিখেছেন, কিন্তু তাঁর বক্তব্য না নিয়েই বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে।
তিনি দুঃখ করে বলেন, “মানবজমিন আমাকে গতকাল যে বিভীষিকাময় দিন উপহার দিয়েছে, এমন দিন আমার জীবনে কখনও আসেনি।”
ফয়েজ দাবি করেন, নগদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষের আইনি লড়াই চলছিল, যেটি থেকে কোম্পানিকে রক্ষা করতে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ‘শাফায়াত গং’ নামক একটি গোষ্ঠীর প্রসঙ্গ তুলে বলেন, তারা হেভিওয়েট ব্যারিস্টার নিয়ে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। এমনকি একটি ‘এজেন্সির’ মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকার দুর্নীতির ‘রিপোর্ট’ ছড়ানোর অভিযোগও তোলেন তিনি।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, বিএফআইইউ (Bangladesh Financial Intelligence Unit)-কে বেশ কিছু টাস্ক দিয়েছেন অনলাইন জুয়া ও হুন্ডি দমনে। এর মধ্যে রয়েছে জিও-ফেন্সিং নির্দেশনা এবং ভুয়া এজেন্টদের চিহ্নিত করা।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আমি কারও ক্ষতি করিনি, দেশের স্বার্থে এসব খাতে শৃঙ্খলা আনতে দিন রাত কাজ করছি।”
সবশেষে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে গিয়ে ফয়েজ লেখেন, “আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং এদেশের মানুষের একটি পয়সাও চুরি করব না—এই আস্থাটা আমার ওপর রাখবেন আশা করি।”
তিনি আরও যোগ করেন, “নগাদ দেশের ৯ কোটি নাগরিকের সাথে যুক্ত। এইটা মরে গেলে দেশের মানুষের ফাইনান্সিয়াল ক্ষতি হবে, প্রতিযোগীরা মাফিয়া মনোপলি হবে, দাম বাড়াবে।”
নগদ এখন আর কেবল একটি মোবাইল আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়—এটি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু। ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের এই অবস্থান ইঙ্গিত দিচ্ছে, সরকার দুর্নীতির অভিযোগে রাজনৈতিক রং না দিয়ে প্রশাসনিকভাবে তদন্তে যেতে চায়।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়: তদন্ত কতটা স্বচ্ছ ও স্বাধীন হবে?