৭৮তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করে ফিরেছে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আলী’। স্বনামধন্য নির্মাতা আদনান আল রাজীব পরিচালিত ১৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রটি পেয়েছে স্পেশাল মেনশন—বিশেষ স্বীকৃতি, যা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে একটি উল্লেখযোগ্য সম্মান। শনিবার (২৫ মে) উৎসবের সমাপনী দিনে এই ঘোষণায় উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশি নির্মাতা ও চলচ্চিত্রপ্রেমীরা।
‘আলী’ মূলত উপকূলীয় এক শহরের গল্প, যেখানে নারীদের গান গাওয়ার অধিকার নেই। এমন প্রেক্ষাপটে বেড়ে ওঠে এক কিশোর, যার স্বপ্ন গান গেয়ে শহরে পাড়ি জমানো। কিন্তু এই গানের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে এক রহস্য, যা সিনেমার মূল কাহিনিকে মোড় নেয় এক অনির্দেশ্য আবহে। সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আল আমিন, যিনি নতুন হলেও তার অনবদ্য অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন কানের দর্শক ও সমালোচকরা।
গায়ে কাঁটা দেওয়া মুহূর্ত
কান উৎসবে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আদনান রাজীব বলেন, “আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল প্রিমিয়ারের আগের রাতটা। ভাবিনি এমন জায়গায় আমাদের সিনেমা পৌঁছাবে। কিন্তু আমি জানতাম, আমি নিজের সত্য বলেছি, এবং সত্য সব সময় অনুভব করা যায়।”
এই সিনেমার শুটিং হয়েছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সিলেটের বিভিন্ন লোকেশনে, টানা পাঁচ দিন ধরে। প্রকৃতিকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে বাস্তবতানির্ভর গল্প, যেখানে লোকজ সংগীত, সামাজিক নিষেধাজ্ঞা এবং কিশোরের স্বপ্ন একত্রে বাঁধা পড়েছে।
‘ক্যাটালগ’-এর যাত্রা এবং কানজয়
আদনান রাজীব ও তানভীর আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত “ক্যাটালগ” নামের একটি নতুন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি হয়েছে এই সিনেমা। প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় গঠিত—বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের চারজন তরুণ নির্মাতা ও প্রযোজকের সম্মিলিত উদ্যোগে। ‘আলী’ ছিল প্রতিষ্ঠানটির প্রথম প্রযোজনা। ২০২4 সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা সিনেমাটি কানে জমা দেয় এবং মনোনয়ন পায় স্বল্পদৈর্ঘ্য শাখায়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
কান উৎসবে ‘আলী’ প্রদর্শনের পর দর্শক ও সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া ছিল আশাব্যঞ্জক। ফ্রান্সভিত্তিক এক চলচ্চিত্র বিশ্লেষক টুইটারে লেখেন, “Ali is a hauntingly poetic tale wrapped in tradition and defiance. A rare voice from Bangladesh that lingers.”
নির্মাতার ভাষ্য: “ভয় নেই, কারণ এটা আমার সত্য”
আদনান আল রাজীব বলেন, “আমি মুখোমুখি হয়েছি একজন নির্মাতা হিসেবে, নিজের গল্প নিয়ে, নিজের ভাষা নিয়ে। ভয় পাইনি, কারণ জানতাম এটা আমার সত্য। আমি বিশ্বাস করি, যখন আপনি সত্যিকারের কিছু বলেন, সবাই সেটা অনুভব করতে পারে।”
‘আলী’-র এই সাফল্য প্রমাণ করে, সীমিত বাজেট, ছোট দৈর্ঘ্য অথবা অভিজ্ঞতা কম থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব মঞ্চে পৌঁছানো সম্ভব। শুধু প্রয়োজন গভীর গল্প, আন্তরিক নির্মাণ ও সাহসী ভাবনা। নতুন প্রজন্মের নির্মাতাদের জন্য এটি হতে পারে এক অনুপ্রেরণার গল্প।
‘আলী’ শুধুই একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা নয়; এটি একটি কণ্ঠ, যা নিরবে চিৎকার করে। একটি স্বপ্ন, যা উপকূল পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে পৌঁছেছে। এবং এটি একটি প্রমাণ, যে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রভুবনের রঙিন ক্যানভাসে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হতে পারে।
বাংলাদেশের সিনেমা ও কান
বাংলাদেশ এর আগেও কানে সুনাম কুড়িয়েছে—২০১৮ সালে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘Live from Dhaka’ এবং ২০২১ সালে তার ‘Rehana Maryam Noor’ সিনেমা আলোচনায় আসে। তবে, স্বল্পদৈর্ঘ্য বিভাগে ‘আলী’র এই স্পেশাল মেনশন পাওয়া খুবই উল্লেখযোগ্য অর্জন। কারণ, কান উৎসবে হাজারো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগী চলচ্চিত্রের মধ্য থেকে এমন স্বীকৃতি পাওয়া বিরল।