ঢাকা শহরে ‘বেঁচে থাকা’ এখন কাদের জন্য?

New-Project-11-8.jpg

ঢাকা শহর

২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ ফারহানা হোসেন

ঢাকা শহর একসময় ছিল স্বপ্নের ঠিকানা। গ্রাম থেকে মানুষ ছুটে আসত জীবিকার খোঁজে, উন্নত জীবনের আশায়। কিন্তু সময় বদলেছে। রাজধানী এখন আর সেই ‘সবাইয়ের শহর’ নেই। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য এই শহর হয়ে উঠেছে শ্বাসরুদ্ধকর। প্রতিদিনের জীবনযাত্রা, ব্যয়, আবাসন সংকট, যানজট, পরিবেশ দূষণ—সব মিলিয়ে ঢাকায় টিকে থাকাই যেন এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশ্ন উঠছে, এই শহরে বেঁচে থাকা আসলে কাদের জন্য?

ভাড়া বাড়ে, আয় বাড়ে না

সাধারণ চাকরিজীবী, ছোট ব্যবসায়ী কিংবা ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ঢাকা শহরে জীবন ধারণ দিনকে দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় বসবাসরত মধ্যবিত্তদের ৭২% মাসের শেষ দিকে ঋণগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে। ভাড়া, বাজার, পরিবহন খরচ—সব কিছু এত দ্রুত বাড়ছে যে, মানুষের আয় সেই গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না।

উত্তরা, মিরপুর, রামপুরা বা মোহাম্মদপুরের মতো মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও ভাড়া এখন নাগালের বাইরে। ১৫-২০ হাজার টাকায় যে ফ্ল্যাট পাওয়া যেত ৫ বছর আগে, সেটিই এখন ৩০ হাজার টাকার কাছাকাছি। বাজারে সবজির দাম প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে। এক কেজি পেঁয়াজ ৮০ টাকা, ডিম ১৫ টাকা করে, চাল ৭০-৮০ টাকা কেজি—মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত হিসাব করে খেতে বাধ্য হচ্ছে।

পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন, দুর্ভোগের নগর

ঢাকায় চলছে অবিরাম ‘উন্নয়ন’। কিন্তু এই উন্নয়ন কার জন্য? রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি, ফুটপাত দখল, গাছ কাটা, নির্মাণ সামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা—এসব দৃশ্য প্রতিদিনের। বাস-রিকশা-মোটরসাইকেলের বিশৃঙ্খল চলাচল নগরজীবনকে বিষণ্ন করে তুলছে। যাত্রীসেবা নয়, বরং ভিআইপি লেন, বিশাল স্থাপনা নির্মাণ আর কর্পোরেট সুবিধার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা ধনী ও প্রভাবশালী শ্রেণিকেই কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, মধ্যবিত্তের সমস্যার কথা কেউ শুনছে না। ফুটপাতে হেঁটে যাওয়ার জায়গা নেই, গণপরিবহন অপ্রতুল, নিরাপত্তার অভাব, পরিবেশ দূষণ—সবই উপেক্ষিত।

শহরের গন্তব্য ধনীদের দিকে

রাজধানীতে গড়ে ওঠা নতুন আবাসন প্রকল্প, বিপণিবিতান বা আধুনিক সেবাগুলো কাদের জন্য? গুলশান-বনানী বা বারিধারার মতো এলাকায় বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, বিদেশি রেস্টুরেন্ট আর ব্যক্তিগত গ্যারেজে দাঁড়িয়ে থাকা দামি গাড়িগুলো যেন এক ভিন্ন পৃথিবী। অথচ সেই শহরেরই অন্যপ্রান্তে কামরাঙ্গীরচর বা বস্তি এলাকায় মানুষ স্যাঁতসেঁতে ঘরে, অপরিচ্ছন্ন ড্রেনের পাশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই বৈষম্য দিন দিন স্পষ্টতর হচ্ছে।

শুধু আবাসন নয়, নাগরিক সেবার ক্ষেত্রেও বৈষম্য প্রকট। গুলশানে বিদ্যুৎ চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই জেনারেটর চলে আসে, আর মধ্যবিত্ত এলাকায় ২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলে পানিও পাওয়া যায় না। শিক্ষার ক্ষেত্রেও শহরের বিভক্তি স্পষ্ট—ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শিশুদের সঙ্গে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জীবন ও ভবিষ্যৎ আলাদা।

কীভাবে বাঁচবে মধ্যবিত্ত?

ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির জীবনে অবসাদ ও হতাশা বাড়ছে। তারা ঘর ভাড়া দিতে গিয়ে জীবনযাত্রার মান বিসর্জন দিচ্ছে। চিকিৎসা, শিক্ষা বা বিনোদন—কোনোটাই আর সহজলভ্য নয়। অনেকে পরিবার নিয়ে শহরের আশেপাশে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন, কেউ কেউ বিদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি ইকবাল হোসেন বলেন, “আমাদের শহরের পরিকল্পনা আর বাস্তবতা এক নয়। শহরের মালিকানা হয়ে যাচ্ছে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির হাতে। এটা খুবই উদ্বেগজনক।”

নাগরিক অধিকার বলতে এখন কেবল কথার কথা। গণপরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা, সুপেয় পানি, নিরাপদ রাস্তা—এসব মৌলিক সুবিধা এখন আর সাধারণ মানুষের নাগালে নেই।

সমাধান কী?

ঢাকাকে বসবাসযোগ্য রাখতে হলে প্রথমেই দরকার ন্যায্যতা ও অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা। গণপরিবহন উন্নয়ন, আবাসন খাতে নিয়ন্ত্রণ, মূল্যস্ফীতি রোধ, বস্তি উন্নয়ন, নগরের সব শ্রেণির মানুষকে কেন্দ্র করে নীতি গ্রহণ—এসব ছাড়া এই শহর টিকবে না।

এখন প্রশ্ন হলো, সরকার কি এই শহরকে সবার শহর হিসেবে দেখতে চায়, নাকি কেবল বিনিয়োগবান্ধব একটি ব্যবসা-নগরে রূপান্তর করতে চায়?

Leave a Reply

scroll to top