আমরা যখন ক্যান্সারের কথা ভাবি, তখন মাথায় আসে স্তন, ফুসফুস বা ত্বকের মতো বহুল আলোচিত নামগুলো। অথচ এক অদৃশ্য ভয়াল ছায়া নিঃশব্দে ঘিরে ফেলছে আমাদের পেটের ভেতর—তার নাম কোলন ক্যান্সার। এই মারাত্মক রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ না দিয়েই শরীরের গভীরে ঘাঁটি গেড়ে বসে, আর এক সময় এনে দিতে পারে মৃত্যুর মুখোমুখি বাস্তবতা।
বিশ্বজুড়ে কোলন ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৫ সাল নাগাদ এক লাখ পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ কোলোরেক্টাল ক্যান্সারে (কোলন ও রেক্টাল ক্যান্সার) আক্রান্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশেষজ্ঞরা। তবে আশার আলোও রয়েছে—এই ক্যান্সারটি যদি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা যায়, তাহলে এটি অন্যতম নিরাময়যোগ্য ক্যান্সার।
কোলন ক্যান্সার কীভাবে জন্ম নেয়?
বৃহদান্ত্রে (কোলনে) জন্ম নেওয়া এই ক্যান্সার সাধারণত শুরু হয় ছোট পলিপ বা কোষগুচ্ছ হিসেবে। সময়ের সাথে সাথে এগুলো ক্যানসারে রূপ নেয়। বৃহদান্ত্রের মূল কাজ খাবার থেকে পানি ও পুষ্টি শোষণ এবং বর্জ্য নিষ্কাশন। ক্যান্সার দেখা দিলে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি নিঃশব্দ থাকে, কোনো লক্ষণ প্রকাশ করে না। কিন্তু সময় গড়ালে দেখা দেয়—মলত্যাগে পরিবর্তন, পেটে ব্যথা, রক্তপাত, অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস ইত্যাদি উপসর্গ।
কারা বেশি ঝুঁকিতে?
অনেকে মনে করেন কোলন ক্যান্সার শুধু প্রবীণদের হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরুণরাও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। নিচে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কারণ তুলে ধরা হলো:
- বয়স: ৫০ বছরের বেশি হলে ঝুঁকি বাড়ে, তবে মিলেনিয়ালরাও এখন নিরাপদ নন।
- পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের কারও মধ্যে কোলন ক্যান্সার থাকলে ঝুঁকি বহুগুণে বাড়ে।
- জিনগত কারণ: লিঞ্চ সিনড্রোম বা FAP-এর মতো জেনেটিক অবস্থা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- জীবনযাপন: লাল মাংস, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফল ও সবজির অভাব, ব্যায়ামের অনীহা, ধূমপান ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ—সবই ঝুঁকির কারণ।
- অন্যান্য রোগ: ক্রোনস ডিজিজ, আলসারেটিভ কোলাইটিস, টাইপ-২ ডায়াবেটিস থাকলেও ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে।
উপসর্গ যেগুলো অবহেলা করবেন না
- বারবার ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য
- মলে রক্ত বা রক্তমিশ্রিত টিস্যু
- হঠাৎ ওজন হ্রাস
- পেটে অস্বস্তি বা দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা
- সবসময় ক্লান্ত অনুভব করা
প্রতিরোধের উপায় কী?
কোলন ক্যান্সার শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য না হলেও সঠিক অভ্যাস গড়ে তুললে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব:
- উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার খান—শস্য, ডাল, ফল, সবজি
- লাল মাংস ও প্রক্রিয়াজাত খাবার কমান
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন
- ধূমপান ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল ত্যাগ করুন
- শরীরের অস্বাভাবিকতা বুঝলে অবহেলা নয়, তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন
কোলন ক্যান্সার কোনো দোররা বাজিয়ে আসে না, আসে নিঃশব্দে। তাই দেরি হওয়ার আগেই সচেতন হন। পরিবারের ইতিহাস জানুন, সঠিক সময়ে স্ক্রিনিং করুন, স্বাস্থ্যবান জীবনযাপন করুন। নীরব এই ঘাতককে দূরে ঠেলে দিতে পারে শুধু আপনার সচেতনতা।
জীবনের দামে সচেতনতা—এখনই সময় নিজেকে রক্ষা করার।