চেকবই রাজত্ব

কলেজের নামে দুর্নীতির বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছিলেন অধ্যক্ষ ফরিদা পারভীন-হিসাবরক্ষক?

Image depicting corruption investigation at Dinajpur Government Women's College, showing documents and money with former principal Farida Parvin and accountant Noor-ul-Alam involved in a 98 lakh taka embezzlement scandal, uncovered by Anti-Corruption Commission.
২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ খান শান্ত, ঢাকা

দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফরিদা পারভীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগে কেঁপে উঠেছে শিক্ষাখাত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত লুটপাটের আস্তানায় পরিণত করে দীর্ঘদিন ধরে বিল-ভাউচারবিহীন টাকা উত্তোলন, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি তহবিল থেকে মোট ৯৮ লাখ ১ হাজার ২৫৬ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ঘাটন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এই বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় তার সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন কলেজের হিসাবরক্ষক (রাজস্ব) মো: নূরুল আলম। একযোগে এ দুই কর্মকর্তা সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে শিক্ষার্থীদের তহবিল থেকে টাকা তুলেছেন নানা অজুহাতে, কখনও মিথ্যা নামে, আবার কখনও সম্পূর্ণ কল্পিত চাহিদাপত্র দেখিয়ে।

কীভাবে গড়ে উঠল দুর্নীতির এই সিন্ডিকেট?

দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, অধ্যক্ষ থাকাকালীন (০৮/০৮/২০২২ – ১৫/০৯/২০২৪) ফরিদা পারভীন ও নূরুল আলম যৌথভাবে কলেজের অন্তত ২০টি ভিন্ন ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে অর্থ লুটে নেন।

এসব হিসাবের কিছু চাঞ্চল্যকর দিক:
• লাইব্রেরি তহবিল, আইসিটি তহবিল, ছাত্রী সংসদ, নিরাপত্তা খাত, চিকিৎসা সেবা তহবিল – কোনো খাতে যথাযথ কার্যক্রম না থাকলেও চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয় লাখ লাখ টাকা।
• ভুয়া নাম ব্যবহার করে পুরাতন ছাত্রদের নামেও ছাত্রী সংসদ তহবিল থেকে টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়।
• চিকিৎসা সেবা বাবদ ১৮ মাসের সম্মানির চেক ইস্যু করা হয় এমন একজন চিকিৎসকের নামে, যিনি কার্যত সে সময় কলেজে ছিলেন না।

ভুয়া বিল, জাল চাহিদাপত্র আর দায়িত্বহীন স্বাক্ষর – দুর্নীতির কৌশল একাধিক
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কোনো একক ঘটনা নয় – এটি একটি সুপরিকল্পিত অর্থ আত্মসাতের অপারেশন। প্রায় সব কাগজপত্রই ছিল হয় ভুয়া, নয়তো চাহিদাপত্র ও বিল ছাড়া। অধিকাংশ চেকে কমিটির স্বাক্ষরই ছিলনা।
জনতা ব্যাংক PLC ও সোনালী ব্যাংক– দুটি ব্যাংকের ২০টি হিসাব থেকে ধারাবাহিকভাবে টাকা উত্তোলনের পরে বেশ কিছু হিসাব বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে তদন্তে ধরা না পড়ে।

দুদকের সুস্পষ্ট পর্যবেক্ষণ ও মামলা রুজু

দিনাজপুর জেলা দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক খায়রুল বাশার কর্তৃক দায়েরকৃত এজাহারে বলা হয়েছে, এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ফরিদা পারভীন এবং নূরুল আলম দণ্ডবিধির ৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

দুদকের প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদিত স্মারক নং-০০.০১.২৭০০.৬৩৬.০১.৪৫০.২৪.২৪১০ এ ৩০ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে মামলার প্রাথমিক অনুমোদনও ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে।

এখানে বলা হয়,
দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ জনাব ফরিদা পারভীন (আইডি-৫৮৮৩) উক্ত কলেজের হিসাব রক্ষক (রাজস্ব) জনাব মো: নূরুল আলম এর সহায়তায় কলেজের বিভিন্ন তহবিল/খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কমিটির আহবায়ক/সদস্যের আবেদন/চাহিদাপত্র ও বিল-ভাউচার ছাড়া কিংবা স্বাক্ষরবিহীন অথবা ভুয়া স্বাক্ষরযুক্ত চাহিদাপত্র ও ভুয়া বিল-ভাউচার প্রস্তুত করে দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজ কর্তৃক জনতা ব্যাংক পিএলসি, বাহাদুর বাজার শাখা, দিনাজপুরে পরিচালিত

(i) বহিঃক্রীড়া তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০০২৩৩১৫৭৪৭ হতে ০৩টি চেকের মাধ্যমে ৭,৯৮,০০০/- টাকা (ii) অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০০২২৯২৮৩৩৮ হতে ০২টি চেকের মাধ্যমে ৪,৫০,০০০/- টাকা (iii) নিরাপত্তা-নৈশপ্রহরী ও অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০০২৩৩১৫৯৯২ হতে ৩৮টি চেকের মাধ্যমে ৯,০৯,০০০/- টাকা (iv) লাইব্রেরী তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০০২২৯২৮১২৫ হতে ০৫টি চেকের মাধ্যমে ১,২৩,৪০০/- টাকা (v) ধর্ম ও সমাজকল্যাণ তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০০২৩৩১৫৯৪১ হতে ২১টি চেকের মাধ্যমে ৫,০৮,০০০/- টাকা (vi) সাহিত্য ও সংস্কৃতি তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০০২৩৩১৫৭৯৮ হতে ২০টি চেকের মাধ্যমে ৬,২১,৪০০/- টাকা।

(vii) উন্নয়ন তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০০২২৯০১৫৫৩ হতে ১১টি চেকের মাধ্যমে ৩,৪৩, ২০০/- টাকা (viii) আইসিটি তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০০২২৯২৮২২২ হতে ০১টি চেকের মাধ্যমে ১,২০,০০০/- টাকা (ix) ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের পর ছাত্রী সংসদের কোনো কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়া সত্ত্বেও ইতঃপূর্বে শিক্ষা জীবন পরিসমাপ্ত হয়েছে এমন শিক্ষার্থীদের নাম ব্যবহার করে ছাত্রী সংসদ তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০০২৩৩১৫৮৪৪ হতে ০৯টি চেকের মাধ্যমে ২,২২,৩৭৫/- টাকা (x) কলেজের শিক্ষক/কর্মচারীদের জন্য কোনো প্রকার পরিবহনের ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও পরিবহন ব্যয় বাবদ পরিবহন তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০২২৬৯০৪০০৪ হতে ০৩টি চেকের মাধ্যমে ৩,৩৫,৭২০/- টাকা।

(xi) ২০২১ সালের পর কুলেজের এসএমএস কার্যক্রম বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এসএমএস তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০১৮৯৯৬১৪৪২ হতে ০৫টি চেকের মাধ্যমে ৭,৭৯,৪৫২/- টাকা (xii) কলেজের আবাসিক শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা: ফরিদা ইয়াসমিন মার্চ/২০২০ এর পর আবাসিক চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন না করলেও তার নামে ভুয়া চাহিদাপত্র ও প্রাপ্তিস্বীকারপত্র প্রস্তুতপূর্বক চিকিৎসা সেবা তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০০২২৯২৮০০১ হতে ০১টি চেকের মাধ্যমে ১৮ মাসের সম্মানি বাবদ ৩,৬০,০০০/- টাকা ও (xiii) বিল-ভাউচারে তহবিল সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর ব্যতিরেকে/ক্ষেত্র বিশেষে চাহিদাপত্র ও বিল-ভাউচার ব্যতীত অথবা ভুয়া চাহিদাপত্র ও বিল-ভাউচার দাখিলপূর্বক বিবিধ তহবিল সংশ্লিষ্ট হিসাব নং-০১০০০২২৯২৮২৮১ হতে ৫৩টি চেকের মাধ্যমে ১৬,৪৫,৬৭৯/- টাকাসহ মোট (৭,৯৮,০০০+৪,৫০,০০০+ ৯,০৯,০০০+ ১,২৩,৪০০+৫,০৮,০০০+ ৬,২১,৪০০+ ৩,৪৩,২০০+ ১,২০,০০০+২,২২,৩৭৫+৩,৩৫,৭২০+৭,৭৯,৪৫২+ ৩,৬০,০০০+১৬,৪৫,৬৭৯)=৭২,১৬,২২৬/- টাকা উত্তোলনপূর্বক আত্মসাত করেন।

কাজেই দেখা যায় যে, জনাব ফরিদা পারভীন দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে (০৮/০৮/২০২২ খ্রি. হতে ১৫/০৯/২০২৪ খ্রি. তারিখ পর্যন্ত) উক্ত কলেজের হিসাব রক্ষক (রাজস্ব) জনাব নূরুল আলম এর সহায়তায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাহিদাপত্র ও বিল-ভাউচার ব্যতীত/ভুয়া চাহিদাপত্র ও ভুয়া বিল-ভাউচার দাখিলপূর্বক দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজের বিভিন্ন খাত/তহবিল সংশ্লিষ্ট ২০টি ব্যাংক হিসাব হতে (৭২,১৬,২২৬+২০,০২,৩৬৯+৫,৮২,৬৬১) = মোট ৯৮,০১,২৫৬/- (আটানব্বই লক্ষ এক হাজার দুইশত ছাপ্পান্ন) টাকা বিধি বহির্ভূতভাবে উত্তোলনপূর্বক আত্মসাত করেন।

প্রশ্ন উঠছে শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আস্থা নিয়ে

এই দুর্নীতির কেলেঙ্কারি কেবল অর্থ আত্মসাত নয়, এটি জনগণের শিক্ষা খাতের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসকে চূর্ণ করে দিয়েছে। যেখানে সরকারি কলেজের ফান্ড ব্যবহৃত হওয়ার কথা ছিল শিক্ষার্থীদের কল্যাণে, সেখানে তা গিয়েছে কিছু অসাধু কর্মকর্তার পকেটে।

এমন শিক্ষা ‘দুর্নীতি’ নয়, ‘শিক্ষাবিধ্বংসী’ অপরাধ!

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা নয়, যেন ছিল এক ‘চেকবই রাজত্ব’! ফরিদা পারভীন ও তার সহযোগীর এই অপরাধ যদি কঠোরভাবে বিচার না পায়, তবে শিক্ষা খাত হবে আরো দুর্বল, দুর্নীতি হবে আরও বেপরোয়া।

Leave a Reply

scroll to top