জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের তিন দফা দাবিতে টানা তৃতীয় দিনের মতো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ শুক্রবার (১৬ মে) সকাল থেকে রাজধানীর কাকরাইল এলাকায় বসা ও শোয়া অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন তারা। জুমার নামাজের পর থেকে গণঅনশন শুরু করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
আন্দোলনের অবস্থান ও পরিবেশ
আজকের কর্মসূচিতে তারা কাকরাইল মোড়ের পরিবর্তে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যাওয়ার সড়কের মুখে অবস্থান নেন। ফলে কাকরাইল মোড় এখন পর্যন্ত উন্মুক্ত রয়েছে এবং যান চলাচল স্বাভাবিক। তবে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, “যদি দাবি না মানা হয়, তবে কাকরাইল মোড় পুনরায় অবরোধের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হবে।” আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী রুবেল রানা বলেন, “আমরা জনগণের ভোগান্তি এড়াতে আপাতত মোড়ের একপাশে অবস্থান নিয়েছি। তবে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী পরবর্তী কর্মসূচি নেওয়া হবে।”
স্লোগানে মুখর প্রতিবাদ
আন্দোলনকারীরা ‘তুমি কে আমি কে, জবিয়ান জবিয়ান’, ‘বৈষম্যের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’—এমন নানা স্লোগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে তুলেছেন।
তিন দফা দাবি:
১. অর্থবছর ২০২৫-২৬ থেকে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন ভাতা চালু করা।
২. জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট কাটছাঁট না করে অনুমোদন দেওয়া।
৩. দ্বিতীয় ক্যাম্পাস বাস্তবায়নে পরবর্তী একনেক সভায় প্রকল্প অনুমোদন ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন।
পূর্বের সংঘর্ষ ও প্রতিক্রিয়া
গত বুধবার কাকরাইল মসজিদের সামনে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জে আহত হন অনেকে। জবি শিক্ষক সমিতির সেক্রেটারি ড. মো. রইছ উদ্দিন বলেন, “পুলিশ যেভাবে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। দাবি আদায় ও বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।” বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. তাজাম্মুল হক বলেন, “সহকারী প্রক্টরের ওপরও হামলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনে পুলিশের এমন অমানবিক আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়।”
পূর্বসূত্র ও পরবর্তী কর্মসূচি
১৩ মে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক প্রতিনিধিরা ইউজিসিতে গিয়েছিলেন দাবি আদায়ে। আশানুরূপ সাড়া না মেলায় ‘লংমার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় ‘জুলাই ঐক্য’ সংগঠনের ব্যানারে। তীব্র প্রতিবাদ ও সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্তি না আসায় আন্দোলনের পরিধি ও গভীরতা ক্রমেই বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা এই আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এখন সবাই অপেক্ষায়—সরকার, ইউজিসি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো আশ্বাস বা পদক্ষেপ আসে কি না।
শিক্ষকদের অবস্থান খানিকটা কৌশলগত
অন্যদিকে, শিক্ষকরা অনেকটাই সংবেদনশীল ও কূটনৈতিক ভাষা ব্যবহার করছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. রইছ উদ্দিন বলেন, “পুলিশের হামলার বিচার না হওয়া এবং শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাব।” তবে শিক্ষক নেতারা সরকারের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনার দিকটিও খোলা রাখছেন, যা শিক্ষার্থীদের তুলনায় কিছুটা নরম অবস্থান বলেই দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,”আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে আছি, তবে সড়কে অনশন বা লংমার্চে যাওয়া শিক্ষকদের জন্য যুক্তিযুক্ত কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।”
দ্বৈত বার্তার ফলাফল
এই ভিন্নমত দাবির প্রতি আন্দোলনের দৃঢ়তা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা অধিকতর রাজনৈতিক ও প্রতিক্রিয়াশীল কৌশলে এগোচ্ছে। শিক্ষকরা চাইছেন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায় করতে। এই বিভাজন দাবিগুলো বাস্তবায়নে চাপ কমাতে পারে, কারণ কর্তৃপক্ষ একক নেতৃত্বের অভাবকে কাজে লাগাতে পারে। প্রশ্ন উঠছে—দাবিগুলো বাস্তবসম্মত হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না, এবং এর সমাধান কোন পথে যাবে? আন্দোলন যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে তা জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষানীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।