একটি ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা ও জাতীয় সংলাপের প্রয়োজন

জাতীয় সংগীত পরিবর্তন: বিশ্বের অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

মুহাম্মাদ নূরে আলম

জাতীয় সংগীত কোনো দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। এটি একটি জাতির ঐক্য ও আবেগের প্রকাশ। তবে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা সামাজিক কারণে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। এই পরিবর্তন কখনো জাতীয় ঐক্যকে শক্তিশালী করেছে, কখনো বিভেদ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ নিয়েও সম্প্রতি পরিবর্তনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, যা নিয়ে বিতর্ক চলছে। এই প্রবন্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কারণ, ফলাফল এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর সম্ভাব্য উপকার ও সমস্যা বিশ্লেষণ করা হলো।

বিশ্বে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের উদাহরণ ও ফলাফল

১. রাশিয়া/সোভিয়েত ইউনিয়ন:
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে রাশিয়া তাদের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করে। সোভিয়েত আমলের সংগীতটি পরিত্যাগ করে মিখাইল গ্লিঙ্কার ‘প্যাট্রিয়টিক সং’ গ্রহণ করা হয়। এটি ছিল সোভিয়েত অতীত থেকে মুক্তির প্রতীক। তবে, ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে পুনরায় সোভিয়েত আমলের সুরটি গ্রহণ করা হয়, তবে নতুন কথা যুক্ত করে।
কারণ: রাজনৈতিক পরিবর্তন, জাতীয় পরিচয় পুনঃস্থাপন এবং সোভিয়েত ঐতিহ্যের প্রতি নস্টালজিয়া।
উপকার: নতুন সংগীত জনগণের মধ্যে জাতীয় গর্ব ও ঐক্যের অনুভূতি জাগিয়েছিল। পুরোনো সুর ফিরিয়ে আনায় পুরোনো প্রজন্মের মধ্যে আবেগের সংযোগ তৈরি হয়।
ক্ষতি: সমাজের একাংশ, বিশেষ করে সোভিয়েত শাসনের বিরোধীরা, পুরোনো সুর ফিরিয়ে আনাকে প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছেন। এটি সমাজে মতবিরোধ সৃষ্টি করে।

২. দক্ষিণ আফ্রিকা:
১৯৯৪ সালে বর্ণবাদের অবসানের পর দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করে। পুরোনো সংগীত ‘ডি স্টেম ভ্যান সুইদ-আফ্রিকা’ বর্ণবাদী শাসনের প্রতীক ছিল। ১৯৯৭ সালে নতুন সংগীত ‘এনকোসি সিকেলেলি আফ্রিকা’ ও ‘ডি স্টেম’ এর সমন্বয়ে একটি সংগীত গ্রহণ করা হয়, যা বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটায়।
কারণ: বর্ণবাদের অতীত থেকে মুক্তি এবং বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য স্থাপন।
উপকার: নতুন সংগীত জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এটি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি বাড়ায়।
ক্ষতি: কিছু শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী পুরোনো সংগীতের অংশ বাদ দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়। তবে, সমন্বিত সংগীত এই বিভেদ কিছুটা কমায়।

৩. জার্মানি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির জাতীয় সংগীত ‘ডয়চল্যান্ডলিড’ এর তৃতীয় স্তবকটি গ্রহণ করা হয়, কারণ প্রথম দুটি স্তবক নাৎসি শাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
কারণ: নাৎসি অতীত থেকে দূরে সরে গিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা।
উপকার: নতুন সংগীত গণতান্ত্রিক জার্মানির পরিচয় তুলে ধরে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়।
ক্ষতি: পুরোনো সংগীতের প্রতি নস্টালজিয়া থাকা কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব: সম্ভাব্য উপকার ও সমস্যা

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ ১৯৭২ সালে গৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গান ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও, মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয়। সম্প্রতি, কিছু গোষ্ঠী এই সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব তুলেছে। তাদের যুক্তি, গানটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনাকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করে না এবং এটি ‘অখণ্ড বাংলা’র প্রতি ইঙ্গিত করে, যা বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সম্ভাব্য উপকার

  • ১. জাতীয় পরিচয়ের নতুন রূপ: নতুন সংগীত বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বতন্ত্র জাতীয় পরিচয়কে আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারে। এটি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে।
  • ২. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়: কিছু প্রস্তাবকারী মনে করেন, নতুন সংগীত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আরও সম্মান করতে পারে, যা সমাজের একাংশের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে।
  • ৩. আধুনিকতার প্রতিফলন: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সংগীত আধুনিক বাংলাদেশের অগ্রগতি ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।

সম্ভাব্য সমস্যা

  • ১. জাতীয় ঐক্যে ফাটল: ‘আমার সোনার বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাঙালি জাতির আবেগের প্রতীক। এটি পরিবর্তন করলে জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে, যারা এই গানের সঙ্গে আবেগের সংযোগ অনুভব করেন, তারা এটিকে তাদের ঐতিহ্যের উপর আঘাত হিসেবে দেখতে পারেন।
  • ২. সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষতি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বব্যাপী বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীক। তাঁর রচিত সংগীত পরিবর্তন করলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হারানোর ঝুঁকি থাকবে।
  • ৩. রাজনৈতিক বিতর্ক: জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব কিছু গোষ্ঠী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে। এটি ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, যা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।
  • ৪. আন্তর্জাতিক পরিচিতি: ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পরিচিতির অংশ। এটি পরিবর্তন করলে নতুন সংগীতের গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি তৈরিতে সময় লাগতে পারে।

একটি ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা
বাংলাদেশের তরুণ কলাম লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী মুহাম্মাদ নূরে আলম সবসময়ই বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও অগ্রগতির পক্ষে কথা বলেন। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলেও এটি স্পষ্ট যে, এই বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সর্বস্তরের জনগণের মতামত গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, জাতীয় সংগীত পরিবর্তন তখনই সফল হয়, যখন এটি জনগণের ব্যাপক সমর্থন পায় এবং জাতীয় ঐক্যকে শক্তিশালী করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’ শুধু একটি গান নয়, এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি পরিচয়ের প্রতীক। এটি পরিবর্তনের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি থাকলেও, এর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না।

তাই, এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের উচিত জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা। সংস্কৃতিবিদ, ইতিহাসবিদ, রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ জনগণের মতামত নিয়ে একটি সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। যেকোনো পরিবর্তন যেন জাতীয় ঐক্যকে শক্তিশালী করে এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সম্মান করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, এটি সমাজে বিভেদ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তন একটি স্পর্শকাতর বিষয়, যা সাবধানতার সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিশ্বের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের উচিত এমন পদক্ষেপ নেওয়া, যা জাতীয় ঐক্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভারসাম্য রক্ষা করে। ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের হৃদয়ে গেঁথে থাকা একটি প্রতীক। এটি পরিবর্তনের আগে আমাদের ভাবতে হবে, এটি কি আমাদের ঐক্যকে শক্তিশালী করবে, নাকি বিভেদের বীজ বপন করবে।

Illustration of a diverse group of people singing a national anthem, symbolizing unity and cultural heritage, with Bangladesh's flag and global landmarks in the background. বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ জাতীয় সংগীত গাইছে, ঐক্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, পটভূমিতে বাংলাদেশের পতাকা এবং বিশ্বের বিভিন্ন ল্যান্ডমার্ক সহ একটি চিত্র।

বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত: 

[Chorus]
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি
[Verse 1]
চিরদিন তোমার আকাশ
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস আমার প্রাণে—
ও মা, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি[Chorus]
সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি[Verse 2]
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা খেতে কী দেখেছি
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি

[Chorus]
সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি

[Verse 3]
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো!
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো
মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন—
ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি

[Chorus]
সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি[Verse 5]
তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে
তোমারই ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে
মরি হায়, হায় রে—
মা, তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে তোমার কোলে—
ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি[Chorus]
সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি[Verse 6]
ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই তোমার রাখাল—
ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি

[Chorus]
সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি[Verse 7]
ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে—
দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ—
মা, তোর ভূষণ বলে গলার ফাঁসি[Chorus]
সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি

Leave a Reply

scroll to top