কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে উত্তপ্ত ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত; আন্তর্জাতিক মহলে বাড়ছে পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা

india-pakistan-war-2025
মুহাম্মাদ নূরে আলম এম আলী

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা বর্তমানে একটি গুরুতর আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়। যদিও সরাসরি পারমাণবিক হামলার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়নি, সাম্প্রতিক উত্তেজনা ও সংঘর্ষের কারণে পরিস্থিতি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।

বর্তমান উত্তেজনা ও সামরিক সংঘর্ষের সূত্রপাত

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল পহেলগামে (ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে) ২৬ জন পর্যটক হত্যার মধ্য দিয়ে সূত্রপাত হয়। এই হামলার দায় initially “দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)” নিলেও পরে তারা দায় অস্বীকার করে। ভারত পাকিস্তানকে এই হামলার জন্য দায়ী করে, যদিও ইসলামাবাদ এর সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে।

এর পরে ২০২৫ সালের মে মাসে, ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়ে জইশ-ই-মোহাম্মদ গোষ্ঠীর শীর্ষ কমান্ডার আবদুল রউফ আজহারকে হত্যা করেছে। এই হামলা পহেলগামের পর্যটক হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে চালানো হয়, যেখানে ২৬ জন নিহত হন। পাকিস্তান এই হামলাকে অযৌক্তিক আক্রমণ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছে ।

এছাড়া, ৭ মে, ২০২৫ তারিখে ১০০টিরও বেশি ভারতীয় ও পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান আকাশে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় বিমান যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে । এই হামলার পর, ভারত ইন্ডাস ওয়াটারস ট্রিটি (১৯৬০) স্থগিত করে, যা পাকিস্তানের জন্য একটি বড় আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ভারত চেনাব নদীর প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়, যার ফলে পাকিস্তানে পানির সরবরাহ প্রায় ৯০% কমে যায় বলে দাবি করা হয়। পাকিস্তান এ পদক্ষেপকে যুদ্ধঘোষণার সমতুল্য বলে অভিহিত করেছে।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

ভারত আরও কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যেমন:

ওয়াগা-আটারি সীমান্ত বন্ধ করা, যা দুই দেশের মধ্যে একমাত্র স্থলপথ যোগাযোগ। পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ। পাকিস্তানি কূটনীতিকদের বহিষ্কার এবং ভারতীয় কূটনীতিকদের পাকিস্তান থেকে প্রত্যাহার। পাকিস্তান পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি স্থগিত ঘোষণা করে, যা দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মূল ভিত্তি। এছাড়া, সীমান্তে গোলাগুলি ও ড্রোন হামলা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে উভয় পক্ষের সামরিক ও বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই উত্তেজনা বর্তমানে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে, কারণ উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রধারী। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও, পরিস্থিতি এখনও স্থিতিশীল হয়নি। এই সংকটের মধ্যে, কাশ্মীরের সাধারণ জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যাদের জীবনযাত্রা ও নিরাপত্তা চরম হুমকির সম্মুখীন।

পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি ও পরিণতি

ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ। পাকিস্তান তার ‘ফুল স্পেকট্রাম ডিটারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে, যা কোনো বড় আক্রমণের মুখে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার দেয় । ভারত ‘নো ফার্স্ট ইউজ’ নীতি অনুসরণ করলেও, অস্ত্রের ব্যবহারকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে না। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি সীমিত পারমাণবিক যুদ্ধও ৫০ থেকে ১২৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে ।

বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি

গবেষণায় দেখা গেছে, একটি সীমিত পারমাণবিক যুদ্ধেও ৫০ থেকে ১২৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হতে পারে। যদি উভয় দেশ তাদের সর্বাধিক শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহার করে, তবে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ১০০ কিলোটন ক্ষমতার একটি বোমা প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করতে পারে। ভারত তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারণ এর জনসংখ্যা বেশি এবং শহরগুলো ঘনবসতিপূর্ণ।

বৈশ্বিক খাদ্য সংকট

পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ড থেকে প্রায় ১৬ থেকে ৩৬ মিলিয়ন টন কালো কার্বন (সুট) পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবাহিত হতে পারে। এটি সূর্যের আলো শোষণ করে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩.৫ থেকে ৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট কমিয়ে দিতে পারে। ফলস্বরূপ, গম, চাল, ভুট্টি ও সয়াবিনের মতো প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১১% পর্যন্ত কমে যেতে পারে, যা বৈশ্বিক খাদ্য সংকট সৃষ্টি করবে।

india-pakistan-war-2025

পরিবেশগত বিপর্যয়

পারমাণবিক যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিশাল পরিমাণ কালো কার্বন প্রবাহিত হবে, যা সূর্যের আলো শোষণ করে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমিয়ে দেবে। এটি দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক তাপমাত্রা হ্রাস, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।

পারমাণবিক শীতলতা (নিউক্লিয়ার উইন্টার)

বিশ্ববিদ্যালয় অব কোলোরাডো বোল্ডার ও রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, পারমাণবিক যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ৮০ বিলিয়ন পাউন্ড কালো ধোঁয়া প্রবাহিত হতে পারে, যা সূর্যের আলো ২০ থেকে ৩৫% পর্যন্ত ব্লক করবে। ফলস্বরূপ, পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যেতে পারে এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫ থেকে ৩০% কমে যেতে পারে, যা বৈশ্বিক খাদ্য সংকট সৃষ্টি করবে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকর ভূমিকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতির কারণে মধ্যস্থতার প্রভাব সীমিত হয়ে পড়েছে । বর্তমানে সরাসরি পারমাণবিক হামলার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না থাকলেও, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতি পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও সংযমের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Reply

scroll to top