বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মনে করেন, দেশের জনগণ এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই ভালো সমাধান হিসেবে দেখছে। তারা চায় একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তাই সরকার জনগণের এই প্রত্যাশা পূরণের দিকেই এগোচ্ছে।
কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যম আল–জাজিরার জনপ্রিয় সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠান ‘টক টু আল–জাজিরা’য় সম্প্রতি এসব মন্তব্য করেন ড. ইউনূস।
রোববার ‘মুহাম্মদ ইউনূস: রিয়েল রিফর্ম অর জাস্ট আ নিউ রুলিং ক্লাস ইন বাংলাদেশ?’ শিরোনামে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হয় আল–জাজিরার ওয়েবসাইটে।
সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য, নির্বাচন আয়োজন, শেখ হাসিনার শাসনামল শেষে দেশের অবস্থা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ড. ইউনূস।
‘জনগণ এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন করছে’
শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা, বিশেষ করে ‘মধুচন্দ্রিমা’ শেষ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন,
“দুটি দিক আছে। একটি হলো জনগণের অধৈর্য। সেটা মধুচন্দ্রিমা শেষ হওয়ার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে এখনো মানুষ মনে করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের জন্য ভালো সমাধান। জনগণ সরকারকে চলে যেতে বলছে না। তারা বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করো। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। এখনো এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যেখানে জনগণ আমাদের দ্রুত সরে যাওয়ার দাবি তুলেছে।”
ড. ইউনূসের ভাষ্য অনুযায়ী, জনগণের চোখে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয়। তাদের মূল দাবি হলো– একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।
নির্বাচন, ডিসেম্বরে নাকি জুনে?
ড. ইউনূস জানান, সরকার চায় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে। এজন্য নির্বাচনপূর্ব সংস্কারের তালিকা ছোট হলে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব হবে। আর যদি সংস্কারের পরিধি বড় হয়, তাহলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন,
“নির্বাচন জুনের পরে যাবে না। সেটি আমাদের প্রতিশ্রুতি।”
এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূস নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার জল্পনা অনেকটাই দূর করেছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন অংশগ্রহণ নিয়ে দ্বিধা
আওয়ামী লীগের নির্বাচন অংশগ্রহণের প্রসঙ্গ উঠলে ড. ইউনূস কৌশলী জবাব দেন। তিনি বলেন,
“আওয়ামী লীগকেই প্রথম সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা নির্বাচনে আসবে কিনা। এখনো তারা কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। এরপর নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কী হবে, সেটাও বিষয়।”
আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন কিনা — এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস ব্যাখ্যা করে বলেন,
“বিষয়টা পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করছে না। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোরও বক্তব্য থাকবে। তাদের কেউ দাবি করতে পারে যে বিদ্যমান আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই।”
ড. ইউনূসের এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগের ভূমিকা এখনো অনিশ্চিত এবং তা নির্ভর করছে দলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও আইনি প্রক্রিয়ার ওপর।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে ড. ইউনূস বলেন,
“আমরা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি, যাতে রোহিঙ্গারা নিরাপদে এবং সম্মানের সাথে তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এমন বোঝাপড়া তৈরি করা, যা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করবে।”
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত যেন অনিশ্চিত না হয়, সেই লক্ষ্যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করছে সরকার।
মোদির সঙ্গে বৈঠক
ড. ইউনূস জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়েছে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে। বৈঠকে দুদেশের সম্পর্কোন্নয়ন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের সহায়তার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
ড. ইউনূসের বার্তা: গণতন্ত্র, সংস্কার ও আস্থা ফেরানো
সাক্ষাৎকারের শেষে ড. ইউনূস বাংলাদেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট বার্তা দেন। তিনি বলেন,
“আমরা শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, একটি বাস্তব, গভীর ও স্থায়ী সংস্কার চাই। আমরা চাই দেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী হোক, জনগণের আস্থা ফিরুক। বাংলাদেশের জন্য এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই সাক্ষাৎকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজনীয়তা, রোহিঙ্গা সংকটের কূটনৈতিক সমাধান এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন অংশগ্রহণ নিয়ে তাঁর খোলামেলা মন্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে।
জনগণের প্রত্যাশা পূরণ এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটুকু সফল হয়, এখন সেটিই দেখার অপেক্ষা।