এক মুঠো বাতাসের খোঁজে মানুষের হাতের তালুতে জন্ম হয়েছিল এক সহজ সরঞ্জামের—হাতপাখা। সভ্যতা বদলেছে, প্রযুক্তি আধুনিক হয়েছে, কিন্তু প্রাচীন এই উপকরণটি রয়ে গেছে তার সরল রূপে, আপন মহিমায়। সময়ের স্রোতে পরিবর্তিত হয়েছে কেবল এর ব্যবহার, নকশা ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের রূপ।
হাতপাখার ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন মিশরে ফেরাউনদের রাজসভায় দাঁড়িয়ে থাকা দাসেরা সোনার কাঠামোয় বাঁধা ময়ূর পালকের পাখা দিয়ে বাতাস করত রাজাকে শীতল রাখতে। চীনের হান রাজবংশ বা জাপানের হেইয়ান যুগেও হাতপাখা ছিল সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। ভারতবর্ষে মন্দির ও আশ্রমে দেবতার সেবায় ব্যবহৃত হতো হাতে দোলানো পাখা।
বাংলায় হাতপাখার ব্যবহার শুরু হয় দেশের তপ্ত আবহাওয়ার কারণে। তালপাতা, খেজুরপাতা ও বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হতো স্থানীয়ভাবে নির্মিত হাতপাখা, যা হয়ে উঠেছিল প্রতিটি ঘরের অনিবার্য সঙ্গী। দুপুরের তপ্ত রোদ কিংবা বিদ্যুৎহীন রাতে হাতপাখার কোমল বাতাসে ঘুমিয়ে পড়ত মানুষ। শুধু প্রয়োজন নয়, কখনো কখনো এই পাখাগুলো হয়ে উঠত ভালোবাসা ও স্নেহের প্রতীক।
ঐতিহ্য থেকে শিল্পে রূপান্তর
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হাতপাখায় যুক্ত হয় শিল্পের ছোঁয়া। শুধু তালপাতার পাখা নয়, দেখা যায় বাঁশের চিকন বুননের রঙিন পাখা, যার গায়ে আঁকা থাকত ফুল, পাখি কিংবা গ্রামীণ জীবনের নকশা। গ্রামীণ মেলা, বৈশাখী উৎসব কিংবা বিয়ের উপহারে দেখা যায় বাহারি হাতপাখার সমারোহ। এসব পাখা হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত রুচি ও সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ।
বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বৈদ্যুতিক পাখার প্রসার ও পরবর্তী সময়ে এসির প্রচলনে হাতপাখার ব্যবহার কমতে থাকে। শহর তো বটেই, বিদ্যুৎ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামেও হাতপাখার প্রয়োজন কমে যায়। কিন্তু এখনো বিদ্যুৎ চলে গেলে কিংবা বিশেষ কোনো ধর্মীয় আয়োজনে এর ব্যবহার দেখা যায়। গ্রামের মাঠে বিশ্রামরত কৃষকের হাতে আজও দেখা যায় পুরোনো সেই হাতপাখার দোলা।
ঐতিহ্যের ছোঁয়ায় বেঁচে থাকা এক শিল্প
যদিও ব্যবহারিক গুরুত্ব অনেকটাই কমেছে, হাতপাখা আজও হারিয়ে যায়নি। বরং হস্তশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পেয়েছে নতুন পরিচয়। মেলা, প্রদর্শনী কিংবা ঘরের দেয়াল সাজানোর উপকরণ হিসেবে হাতপাখা ফিরে এসেছে নতুন জীবন নিয়ে। নস্টালজিয়ার আবেশে কিংবা ঐতিহ্য সংরক্ষণের চেষ্টায়, এই সরল পাখাটি আজও বেঁচে আছে বাংলার প্রাণে।
হাতপাখা শুধু বাতাস দেওয়ার একটি যন্ত্র নয়, এটি ইতিহাসের জীবন্ত সঙ্গী, সংস্কৃতির নিদর্শন ও ভালোবাসার স্মারক। আধুনিকতার ঝলকে হারিয়ে গেলেও তার কোমল দোলা আজও মনে করিয়ে দেয়—আমরা একদিন তালপাতার বাতাসে স্বপ্ন দেখতাম, আর মাটির ঘ্রাণে জীবন খুঁজে পেতাম।