চাকরিতে ফিরছেন জোর করে পদত্যাগ করানো শিক্ষকরা

New-Project-2025-01-22T181049.410.jpg
নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকার পতনের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ‘জোর করে’ পদত্যাগ করানো হয় দুই হাজারের বেশি শিক্ষককে। অনেকের ক্ষেত্রেই পদত্যাগপত্র লিখে নিয়ে পদত্যাগ পত্রে সাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ছয় মাস তারা বেতন পাচ্ছেন না। এই শিক্ষকদের বেতন চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সরকারি তদন্তে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ না মিললে তাদের চাকরিতেও ফিরিয়ে নেওয়া হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সিদ্দিক জোবায়ের সাংবাদিকদের বলেন, পদত্যাগের প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত চলাকালে সবার বেতন চালু থাকবে। অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণিত না হলে চাকরি ফিরে পাবেন। যাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়বে, মন্ত্রণালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ অনেকেই শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। দুর্নীতি ও অপকর্মের কারণেও কেউ কেউ পলাতক।

দেখা গেছে, কোথাও কোথাও সরকার পরিবর্তনের পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছু শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতা শিক্ষার্থীদের হাতিয়ার বানিয়ে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে পদত্যাগ করিয়েছেন। তাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও আক্রোশ থেকে শিক্ষার্থীদের ইন্ধন দিয়ে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করেন তারা। শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে শিক্ষকের স্ট্রোক করার ঘটনাও ঘটেছে। এমন কি মারা যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অতীতে সরকার পরিবর্তন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতেন। এবারই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমা পেরিয়ে মাধ্যমিক ও কলেজেও পদত্যাগের হাওয়া লেগেছে। তারা বলেন, ভিসিদের নিয়োগ চার বছরের। আর স্কুল-কলেজের প্রধানদের নিয়োগ স্থায়ী। চাপে পড়ে ইস্তফা দিলেও পরে তারা এখন আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। সেই সংখ্যা আট শতাধিক।

গত আগস্টের পর থেকে সারাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত দুই হাজার প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের কাউকে অপসারণ করা হয়েছে। কাউকে বরখাস্ত বা বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে। কাউকে আবার অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে কর্মস্থলে। এসব অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকরা সম্প্রতি আগের পদে বহালের জন্য রাজধানীতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেছেন।

এই শিক্ষকদের নেতৃত্ব দেওয়া ‘পদবঞ্চিত প্রতিষ্ঠানপ্রধান শিক্ষক জোট’-এর আহ্বায়ক আনোয়ার ইসলাম তালুকদার বলেন, শিশুদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে সততা, নিষ্ঠা ও নৈতিকতার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে স্বার্থলোভী লোকদের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়েছি আমরা। তারা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে, দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে নিয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, যা অস্বাভাবিক, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।

তিনি আরও বলেন, কেউ চাকরি হারিয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই হয়রানি থেকে আমরা রক্ষা পেতে চাই, নিরাপদে বাঁচতে চাই।

গত বছরের ২১ আগস্ট সচিবালয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছিলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে দায়িত্বরতদের জোর করে পদত্যাগ ও অপমান করা যাবে না। কারও বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে উপদেষ্টার সেই আহ্বান তখন কেউ শোনেনি।

ঢাকা জেলাতেই অন্তত দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানপ্রধান পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। পদত্যাগে বাধ্য হন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী ও কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ফারহানা খানম। ১১ আগস্ট ভিকারুননিসার প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে তারা পদত্যাগপত্র লিখে দেন। ড. ফারহানা খানম বলেন, আমাকে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করানো হয়েছে। আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিনি। একই কথা জানান কেকা রায় চৌধুরীও। কেকা রায় ও ড. ফারহানা বেগম দু’জনই উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন।

আগস্টের পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া ঢাকার অধ্যক্ষ/প্রধান শিক্ষকরা হলেন– রাজধানীর খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্টাফ কোয়ার্টার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সরদার মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, বনানী মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক কাজী শফিকুল ইসলাম, বিসিএসআইআর স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক ড. মো. ইদ্রিস আলী, রামপুরা একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হোসনে আরা এবং দোহার উপজেলার জয়পাড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ এস এম আব্দুল খালেক।

আরও রয়েছেন– গুলশান মডেল হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ এম মুস্তফা জামান মিয়া, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক জোহরা জবীন, মিরপুর নাজনীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. নুরুল ইসলাম, ধামরাই ওদুদুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রাজ্জাক, কেরানীগঞ্জ কলাতিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুজ্জামান জামাল, লালবাগ সালেহা উচ্চ বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম, নতুন জুরাইন কে এম মাঈনুদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ মো. আব্দুল হাই, বনানী মডেল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহম্মদ জহিরুল ইসলাম, শ্যামপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম, শ্যামপুরের বর্ণমালা আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক খান নাসির উদ্দিন, ডেমরার অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তালুকদার আব্দুল মন্নাফ এবং কেরানীগঞ্জের আগানগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন।

এর বাইরে অপসারণ করা হয়েছে লালবাগের আহমেদ বাওয়ানী একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোশারফ হোসেন মুন্সী, প্রতিষ্ঠানের সভাপতি কর্তৃক বরখাস্ত হয়েছেন ডেমরা থানার মানিকনগর মডেল হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোসা. ফেরদৌসি ইয়াসমিন এবং জোরপূর্বক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে ডেমরার মান্নান হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম ও মিরপুর মডেল একাডেমির প্রধান শিক্ষক শুভাশীষ কুমার বিশ্বাসকে। আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বাসভবন থেকে পালিয়ে গেছেন বাড্ডা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরান ঢাকার এক প্রতিষ্ঠানপ্রধান বলেন, গত সেপ্টেম্বর মাসে আমার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ঠিক হয়েছিল। আগস্টেই আমাকে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেওয়া হয়। চাকরি হারানোর কারণে এখনও মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানটি করতে পারিনি।

ধামরাইয়ের এক প্রধান শিক্ষক বলেন, অপমান-অপদস্থ হয়ে নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগ করে আসতে হয়েছে। এখন চরম আর্থিক সংকটে দিনাতিপাত করছি। এ বয়সে কি আর কেউ চাকরি দেবে?

জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য হওয়া শিক্ষকদের বিষয়ে একটি মৌলিক সিদ্ধান্তে এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ১৫ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এক চিঠিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালককে এ শিক্ষকদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়, শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগের ক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে যৌক্তিক অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিষয়ে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর মন্ত্রণালয় যথাযথ নির্দেশনা জারি করবে। যাদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের প্রমাণ মিলবে না, তারা চাকরিতে ফিরবেন। তদন্ত প্রতিবেদন আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বেতন-ভাতা চালু থাকবে।

এই সিদ্ধান্তের পর আশার আলো দেখছে অসহায় শিক্ষকরা।

Leave a Reply

scroll to top