ভারতে সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা জোরদার করার অংশ হিসেবে পাঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ, গুজরাট, রাজস্থান এবং হিমাচল প্রদেশের ২৪টি বিমানবন্দর বেসামরিক বিমান চলাচলের জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ভারতের বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার
বেসামরিক বিমান চলাচল নিরাপত্তা ব্যুরো (BCAS) দেশটির সকল বিমান সংস্থা ও বিমানবন্দরকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, সকল বিমানবন্দরে যাত্রীদের জন্য সেকেন্ডারি ল্যাডার পয়েন্ট চেকিং (SLPC) চালু করা হয়েছে এবং টার্মিনাল ভবনে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে । এছাড়াও, এয়ার ইন্ডিয়া ও অন্যান্য বিমান সংস্থাগুলি যাত্রীদের বিমান ছাড়ার কমপক্ষে তিন ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে উপস্থিত হতে এবং চেক-ইন ৭৫ মিনিট আগে সম্পন্ন করতে পরামর্শ দিয়েছে ।
৯০টি উড়ান বাতিল
এই পদক্ষেপগুলি সাম্প্রতিক পাকিস্তানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রেক্ষিতে গৃহীত হয়েছে, যদিও পাকিস্তান এই হামলার দায় অস্বীকার করেছে। দিল্লি বিমানবন্দরে ইতিমধ্যে ৯০টি উড়ান বাতিল করা হয়েছে এবং দেশের মোট ২৭টি বিমানবন্দরে বাণিজ্যিক বিমান চলাচল বন্ধ রয়েছে । এই পরিস্থিতিতে যাত্রীদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে তাদের নির্ধারিত ফ্লাইটের সর্বশেষ তথ্য জানার জন্য সংশ্লিষ্ট বিমান সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। BCAS-এর পক্ষ থেকে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশের সব বিমানবন্দরে এখন থেকে যাত্রীদের জন্য সেকেন্ডারি ল্যাডার পয়েন্ট চেকিং (SLPC) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থাৎ বিমানে ওঠার আগে ফাইনাল চেকিংয়ের সময় যাত্রীদের আরও এক ধাপে তল্লাশি ও পরিচয় যাচাইয়ের মুখোমুখি হতে হবে।
সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
এছাড়াও, টার্মিনাল ভবনে সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যাতে করে কোনোভাবেই সন্দেহজনক ব্যক্তি বা বস্তু বিমানবন্দরে ঢুকতে না পারে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে আরও সমন্বয় আনতে ভারতীয় বিমানবাহিনী, সিআইএসএফ, এনএসজি এবং রাজ্য পুলিশের সঙ্গে একাধিক জরুরি বৈঠক চলছে বলেও জানা গেছে। বৃহস্পতিবার (৮ মে) সন্ধ্যার দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এক বিস্ফোরক অভিযোগ তোলে—জম্মু, পাঠানকোট ও উধমপুরে অবস্থিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি এবং জম্মু বিমানবন্দরের ওপর পাকিস্তানের দিক থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের মাধ্যমে হামলা চালানো হয়েছে।
ভারতের অভিযোগ “পুরোপুরি ভিত্তিহীন’’ বললো পাকিস্তান
তবে ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায়, এসব হামলা সফলভাবে প্রতিহত করা হয়েছে এবং কোনো বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তা সত্ত্বেও দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করা হয়। সাম্প্রতিক এই ঘটনার সূত্র ধরেই দেশটির নিরাপত্তা বিভাগ এয়ার স্পেস ও বিমানবন্দরগুলোকে উচ্চমাত্রার সতর্কতার আওতায় নিয়ে আসে। দেশটির বিমানবাহিনী ও সিআইএসএফ সদস্যদের দিয়ে বিমানবন্দর এলাকায় বাড়তি টহল চালানো হচ্ছে। ভারতের এই অভিযোগকে “পুরোপুরি ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে উড়িয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ। তিনি বলেন, “পাকিস্তান যদি কখনো ভারতের ওপর হামলা করে, তাহলে তা গোপন থাকবে না, পুরো বিশ্ব সেটা জানবে। ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা ঢাকতেই এসব অভিযোগ আনছে।”
তিনি আরও বলেন, “পাকিস্তান শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে চায়, তবে যদি কোনো আগ্রাসন হয়, তার যোগ্য জবাবও দিতে প্রস্তুত।” এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে দেশজুড়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বিমানযাত্রীদের মধ্যে। অন্তত ১৪টি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ও ৭টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। দিল্লি, মুম্বাই, চণ্ডীগড় এবং আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে বিমান চলাচলের ওপরও আংশিক প্রভাব পড়েছে। এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীদের টিকিট রিফান্ড ও পুনঃনির্ধারণের বিষয়ে নতুন গাইডলাইন দিচ্ছে, তবে যাত্রীদের অভিযোগ, শেষ মুহূর্তে বাতিল হওয়া ফ্লাইটের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সফর, চিকিৎসা বা চাকরিজনিত কাজে তারা মারাত্মক সমস্যায় পড়ছেন।
ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রভাব
ভারতের অভ্যন্তরে এই নিরাপত্তা সতর্কতার মাত্রা নজর কেড়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রভাবকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। কাশ্মীর সীমান্তে হামলার অভিযোগ এবং বিমানবন্দরগুলোতে জারি করা সর্বোচ্চ সতর্কতা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে অনেকটাই অস্বস্তিকর করে তুলেছে। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এ ধরনের সামরিক উত্তেজনা দীর্ঘমেয়াদে শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নয়, গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘ফ্যান্টম ডিফেন্স’ : পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী সম্প্রতি ভারতের বিরুদ্ধে “ফ্যান্টম ডিফেন্স” বা “ভৌতিক প্রতিরক্ষা” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি ভারতের দাবি অনুযায়ী পাকিস্তান ১৫টি স্থানে হামলা চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ করেছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও কল্পনাপ্রসূত বলে অভিহিত করেছেন ।
এক সংবাদ সম্মেলনে চৌধুরী বলেন, “ভারত সরকারকে ‘সিনেমা’ থেকে ‘বাস্তব’ জগতে ফিরে আসার আহ্বান জানাই।” তিনি আরও বলেন, “পাকিস্তান যখন ভারতে হামলা চালাবে, তখন এর প্রতিধ্বনি সব জায়গায় শোনা যাবে।” তিনি ভারতের প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও প্রমাণেরও সমালোচনা করেন, দাবি করেন যে সেগুলো শুধুই ফাঁকা মাঠের ছবি । এই বক্তব্যের মাধ্যমে পাকিস্তান ভারতের সাম্প্রতিক হামলার দাবিকে অস্বীকার করেছে এবং উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগও বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা নিয়ে।