স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

New-Project-14-2.jpg
২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ

বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস (বিএইচএস) গঠনে সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে অর্ডিন্যান্স আকারে আইন প্রণয়নে বিষয়াদি সুপারিশ করেছে কমিশন। এ সংক্রান্ত সুপারিশে বলা হয়েছে, সর্বজনীন ও সহজলভ্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য সংশ্লিষ্ট খাতের সঙ্গে এবং জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে সেবার ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এসময় যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ‍্য তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।

সোমবার (৫ মে) স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।

স্বতন্ত্র ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস’ গঠন: প্রশাসনিক কাঠামোর আমূল রূপান্তর

স্বাস্থ্য কমিশনের সবচেয়ে বড় প্রস্তাব হলো—বর্তমান বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার বিলুপ্ত করে একটি স্বতন্ত্র ও পেশাভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো গঠন, যার নাম হবে ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস’। কমিশনের মতে, চিকিৎসাসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা—এই তিনটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের খাতকে এক ছাতার নিচে বিসিএস কাঠামোয় ফেলা হয়েছে, যার ফলে ক্যারিয়ার পরিকল্পনা, পেশাগত উন্নয়ন ও সেবা মানের অবনতি ঘটেছে।

নতুন প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবায় আলাদা ‘পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য)’ গঠনের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া আরও দক্ষ ও প্রাসঙ্গিক হবে। একইসঙ্গে সুস্পষ্ট ক্যারিয়ার ট্র্যাক তৈরি করে স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের পদোন্নতির একটি স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। এতে করে দীর্ঘদিন একই পদে পড়ে থাকার হতাশা দূর হবে এবং দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতির সুযোগ তৈরি হবে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সেবা বিভাগ পৃথক করার প্রস্তাব

কমিশন আরও বলেছে, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একইসঙ্গে শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা চলায় কার্যকর প্রশাসনিক তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। তাই একাডেমিক (শিক্ষা) হাসপাতাল ও সার্ভিস হাসপাতাল আলাদা করে তাদের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ব্যবস্থা চালু হলে শিক্ষকতা ও সেবাদানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা সহজ হবে এবং উভয় খাতে গুণগত মান বাড়বে।

বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও জনবল নিশ্চয়তা

কমিশনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হলো—দেশজুড়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে নিশ্চিত করা। বিশেষ করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বিনামূল্যে ওষুধ, চিকিৎসা এবং পরীক্ষা সেবা সহজলভ্য করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া নতুন করে হাসপাতাল স্থাপনের আগে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ডিজিটাল হাজিরা ও সরেজমিন তদারকি ব্যবস্থার মাধ্যমে চিকিৎসকদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে কমিশন।

বাজেট বরাদ্দের নতুন পদ্ধতি ও দালালমুক্ত পরিবেশ

কমিশনের মতে, এখনো অনেক সরকারি হাসপাতাল বাজেট পায় শয্যার সংখ্যা অনুযায়ী, যা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে যায় না। তাই চিকিৎসাসেবাগ্রহণকারীর সংখ্যা ও সেবার মান অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দের একটি বাস্তবসম্মত পদ্ধতির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

একইসঙ্গে হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে সাধারণ রোগীরা হয়রানির শিকার না হন।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন ও রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ গঠন

চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীদের অধিকার রক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কমিশন একটি ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি, ল্যাবরেটরি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে একটি স্বাধীন রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান মান নিয়ন্ত্রণ, লাইসেন্স প্রদান এবং তদারকি করবে।

ফিজিওথেরাপি সেবা ও পদ সৃষ্টি

চিকিৎসাক্ষেত্রে আরেকটি অবহেলিত শাখা হলো ফিজিওথেরাপি। কমিশন বলেছে, অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে এই সেবা নেই, অথচ মেরুদণ্ড, পক্ষাঘাত, বয়স্ক রোগীদের জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি। তাই সব মেডিকেল কলেজ ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ফিজিওথেরাপি বিভাগ এবং ফিজিওথেরাপিস্ট পদের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে।

কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য আউটসোর্সিং মডেল

গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য এনজিও বা বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে আউটসোর্সিং ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছে কমিশন। তবে তারা বলছে, এ ব্যবস্থায় সরকার একটি সুনির্দিষ্ট চুক্তি ও বাজেটের আওতায় পরিচালনার দায়িত্ব দেবে, যাতে জবাবদিহিতা বজায় থাকে এবং সেবার মানের অবনতি না ঘটে।

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের এই রিপোর্ট শুধু একটি সুপারিশপত্র নয়, বরং এটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আধুনিক, দক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করে গড়ে তোলার একটি কর্মপরিকল্পনা। কমিশনের এই প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুলবে বলেই আশা করা হচ্ছে।

তবে, এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক সক্ষমতা এবং পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ। এখন দেখার বিষয়, সরকার এই রিপোর্টকে কীভাবে গ্রহণ করে এবং বাস্তবায়নের পথে কতটা অগ্রসর হয়।

Leave a Reply

scroll to top