জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বর্তমানে এক গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এর কাঠামোগত সংস্কার এবং জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ রাজস্ব ব্যবস্থার দাবিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’, যা দেশের রাজস্ব প্রশাসনের ভবিষ্যৎ রূপ নিয়ে এক নতুন বিতর্ক এবং সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ মূলত এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যা দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব বোর্ডের অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থা, অদক্ষ নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান গঠনের লক্ষ্যে সোচ্চার। ২২ মে, ২০২৫ তারিখে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে তারা একটি বিস্তারিত আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। এতে পরিষদ জানায়, সরকারের বিবৃতি আশাব্যঞ্জক হলেও তাদের চারটি মৌলিক দাবি এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
চার দফা দাবি: কাঠামোগত পরিবর্তনের মূল সোপান
পরিষদের দাবিগুলো একদিকে যেমন সরাসরি প্রশাসনিক সংস্কারের দিকে নির্দেশ করে, তেমনি আরেকদিকে অংশগ্রহণমূলক নীতিনির্ধারণের দাবি তোলে। দাবিগুলো হলো:
বিতর্কিত অধ্যাদেশ বাতিল: রাজস্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণমূলক ‘অধ্যাদেশ’ বাতিল করে স্বাধীন ও দক্ষ এনবিআর গঠনের আহ্বান।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পদায়নকৃত চৌধুরী রকমত আলীর অপসারণ: একজন অনভিজ্ঞ ও রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকর্তার অপসারণ দাবি, যিনি নাকি এনবিআরের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা বিঘ্নিত করছেন।
জনসম্পৃক্ত সংস্কার প্রক্রিয়া: প্রণীত খসড়া ও সংস্কার কমিটিতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ।
সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক সংস্কার নীতি: একটি সর্বজনগ্রাহ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর এনবিআর গঠনের লক্ষ্যে সংস্কার প্রক্রিয়ায় সকল অংশীজনের সক্রিয় সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।
সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে ‘অবকাঠামোগত কিছু পদক্ষেপ’ নেওয়ার কথা বলা হলেও তা এখনো পরিষদের কাছে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়নি। বিশেষ করে বিতর্কিত অধ্যাদেশের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া এবং ব্যক্তিপর্যায়ের অপসারণ প্রসঙ্গে নীরবতা পরিষদের অসন্তোষ বাড়িয়েছে।
পরিষদ ২৪ মে পর্যন্ত ‘কলম বন্ধ’ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে শুধুমাত্র আবশ্যিক সরকারি দায়িত্ব পালন করা হবে, তবে অন্যান্য সব প্রশাসনিক কাজ স্থগিত থাকবে। আন্দোলনকারীরা এ কর্মসূচিকে “প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ” হিসেবে ব্যাখ্যা করে বলেছে—তারা দেশব্যাপী রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরো মানবিক ও টেকসই করতে এই উদ্যোগ নিয়েছে।
বিশ্লেষণ: এনবিআর কি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বলয়ে?
পর্যবেক্ষকদের মতে, এনবিআর-এর সংস্কার প্রক্রিয়াকে ঘিরে বর্তমান পরিস্থিতি শুধু একটি প্রশাসনিক বিতর্ক নয়, বরং এটি রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যকার আস্থার সম্পর্কের প্রতিফলন। এনবিআর দীর্ঘদিন ধরেই রাজস্ব আদায়ে দক্ষতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতিতে ভুগছে। এ প্রেক্ষাপটে একটি স্বাধীন, জবাবদিহিমূলক ও প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গঠন সময়ের দাবি। তবে সেটি হতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
চার দফা দাবিগুলো নিয়ে সরাসরি এবং খোলামেলা আলোচনায় বসা, জনসম্পৃক্ত কমিটি গঠন, এবং ভবিষ্যতের রাজস্ব কাঠামো কেমন হবে সে বিষয়ে একটি সর্বজনগ্রাহ্য রূপরেখা প্রকাশ করা। কারণ, একটি টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থাই পারে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল রাখতে, এবং এনবিআরের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে।