চুয়াডাঙ্গা শহরের হাসপাতাল সড়কে অবস্থিত জনতা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে লাইসেন্স না থাকার অপরাধে ৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং ক্লিনিক সিলগালা করা হয়েছে। রোববার সকাল ১০টায় চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ যৌথ অভিযানে এ ব্যবস্থা নেয়। এছাড়াও, ওই ক্লিনিকে দুই রোগী মৃত্যুর ঘটনায় দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি হবে বলে জানিয়েছেন চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ডা. হাদী জিয়া উদ্দীন আহমেদ।
অভিযান সূত্রে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সামনে ট’বাজারে অবস্থিত জনতা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গত ৯ ফেব্রুয়ারী এক প্রসূতি ও ১৮ ফেব্রুয়ারী আরেকজন প্রসূতির মৃত্যু হয়। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধামা-চাপা দেয়ার নানা পায়তারা করে। তবে বিষয়টি শেষমেষ স্বাস্থ্য বিভাগের কানে পৌছালে জেলা প্রশাসন এবং স্বাস্থ্যবিভাগ ওই ক্লিনিকে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে আরও বেড়িয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অফিস সময়ে সেসরকারি ওই ক্লিনিকটিতে জেলা মাতৃ সনদের শাসসুন্নাহার শম্পা নামে একজন সরকারি চিকিৎসক সেবা দিচ্ছিলেন।
সিভিল সার্জন ডা. হাদী জিয়া উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘দুেই রোগী মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম। কেউ কোনো তথ্য দেয়নি। আমরা বিষয়টি জানার পর এই ক্লিনিকে অভিযান পরিচালনা করি। এখানে এসে দেখি, ক্লিনিকটির লাইসেন্স নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যে সকল নিয়ম মানা প্রয়োজন, তা এখানে মানা হয়না। একজন মাত্র ডিপ্লোমা নার্স উপস্থিত ছিলেন। কমপক্ষে আরও তিনজন নার্স থাকার প্রয়োজন ছিলো। যে ধরনের বিধি ব্যবস্থা নিয়ে রেজিষ্টার মেইনসহ অপারেশন করা দরকার ছিলো, সেই বিধি তারা প্রতিপালন করেননি। লাইসেন্স পাওয়া পর্যন্ত ক্লিনিকটি সিলগালা করা হয়েছে এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো সরকারি ডাক্তার অফিস সময়ে ক্লিনিকে সেবা প্রদান করতে পারবেন না। এখানে একজন সরকারি ডাক্তার পাওয়া গেছে। যেহেতু তিনি পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকরি করেন। আমরা বিষয়টি লিখিতভাবে পরিবার পরিকল্পনায় জানাবো। দুইজন রোগী মৃত্যুর ঘটনায় দুইটি আলাদা আলাদা তদন্ত কমিটি করা হবে। সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
অভিযানে আরও উপস্থিত ছিলেন, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আওলিয়ার রহমান, জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট , সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. সাজিদ হাসান প্রমুখ।
এদিকে, অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে জরায়ু অপারেশনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সনো ডায়গনস্টিক সেন্টারে যান জীবননগরের রফিকুল ইসলামের স্ত্রী মর্জিনা খাতুন। সেখান থেকে দালাল চক্রের মাধ্যমে অপারেশনের জন্য ভর্তি হন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল সড়কের অদূরে ট’ বাজারের জনতা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেদিন বিকেলেই মর্জিনা খাতুনকে অপারেশনের জন্য থিয়েটারে নেওয়া হয়। তার জরায়ু অপারেশন করেন ডা. তাসনীম সারোয়ার। অপারেশনের পর তাকে কেবিনে নেওয়া হয়।
এরপরই শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয় মর্জিনা খাতুনের। আবারও তাকে নেয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে রোগীর পরিবারকে রাতেই দ্রুত রাজশাহী নেয়ার পরামর্শ দেন ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। রাজশাহী নেওয়ার পথে মুন্সিগঞ্জ এলাকায় পৌঁছালে মারা যান মর্জিনা খাতুন। পরে তাকে সরাসরি জীবননগরের নিজ বাড়িতে নেওয়া হয়।
এছাড়াও, গত ৯ তারিখ গত ৯ ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের সাতগাড়ি এলাকার বিষ্ণু কুমার দাসের স্ত্রী ময়না রানী প্রসব বেদনা নিয়ে জনতা ক্লিনিকে ভর্তি হন। সেদিনই তাকে সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়। অপারেশন করেন ডা. শিরিন আক্তার। তবে এই অপারেশনে অ্যানেসথিসিয়া বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। কোনো এরপর ওই প্রসূতির শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। একপর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ময়না রানী। তবে ভূমিষ্ঠ শিশুর অবস্থা শঙ্কামুক্ত।
মর্জিনা খাতুনের স্বামী রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘কোনোরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই তড়িঘড়ি করে অপারেশন করানোর কথা বলে। ওইদিনই অপারেশন করার পর থেকেই অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। এমন অবস্থায় ক্লিনিকের লোকজন দ্রুত সেখান থেকে আমাদের অন্য জায়গায় সরানোর জন্য রাজশাহীতে নিতে বলে। পথেই তার মৃত্যু হয়।’
ময়না রানীর মামাতো ভাই বলেন, ‘৭ তারিখে সিজার করা হয়। তখন রক্ত লাগবে জানতে চাইলে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ জানায় রক্ত লাগবে না। তবে রাতে জানায় রক্ত লাগবে। পরে ম্যানেজ করে ওই দিন ২ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছিল। পরের দিন আরও এক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। রক্ত দেওয়ার পর কোনো সমস্যা হতে পারে এমন কোনো সতর্ক তারা করেনি। এরমধ্যে ১৪ তারিখ রাতে সাড়ে ১২টার দিকে প্রেসার অনেক হাই হয়ে যায়।
তখন তাদের সাথে কথা বললে ওষুধের কথা বলে। আর এক ঘণ্টার মধ্যে প্রেসার না কমলে নিয়ে যেতে বলে। ওটা খাওয়ার পর কমে যায়। তবে সকাল বেলা খেচুনি শুরু হয় । এরপর সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে তারা সেখানে নিয়ে যেতে বলে। সেখানে নিয়ে গেলে ইনজেকশন করার পর সে ঘুমিয়ে গেল। এরপর তারা বলল প্রেসার ডাউন হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙলে ঠিক হয়ে যাবে। এরপর আর তার জ্ঞান ফেরনি।’
ময়না রানীর মামি পুষ্পা রানী বলেন, ‘পৌনে ৩টার দিকে আমাদের জানায় আপনাদের রোগীর অবস্থা ভালো না। তাড়াতাড়ি আইসিইউ রুমে ঢুকাতে হবে। রাজশাহীতে নিয়ে যান। তারপর ওরাই অ্যাম্বুলেন্স তুলে দিয়েছে। তারা মেয়ের হাতের আঙ্গুলে হার্টবিটের কি জানো লাগিয়ে দিয়েছিল, কোনো আপডাউন করছিল না। ওই অবস্থায় আমরা রাজশাহী পর্যন্ত নিয়ে গেছি মেয়ে মনে হয় বাঁচবে বলে। রাজশাহীতে পৌঁছানোর পর রোগীর সঙ্গে ক্লিনিক থেকে আসা নার্স আর একজন বলছিল আপনারা রোগী নামিয়েন না, আগে দেখেন রোগী আছে কী না। ২০ মিনিট আগ থেকে রোগীর পাল্স পাচ্ছে না।
পরে পপুলারে নিয়ে গেলাম, তবে তারা ইমারজেন্সি রোগী বলে মেডিকেলে নিতে বলে। মেডিকেলে নিলে রোগী নামাতে হবে এ জন্য পরে মিশনে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা পরীক্ষা করে জানায় রোগী ৪-৫ ঘণ্টা আগে মারা গেছে। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাওয়ার সময় নার্স বার বার মেয়ের মুখের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে রাখছিলো। তবে হার্টবিট উঠছিল না বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে জনতা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বত্বাধিকারী মো. জান্নাতকে ফোন করা হলে তিনি দেখা করে কথা বলার জন্য বলেন।