কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র গৌরাঙ্গবাজার তার প্রায় আধা কিলোমিটার পূর্বে একরামপুর মোড়। জেলার পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি উপজেলার বিপুলসংখ্যক যানবাহন রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকায় যেতে হলে পার হতে হয় একরামপুর মোড়। ফলে দিনের বেশির ভাগ সময় এ মোড় থাকে যানবাহনের দখলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থেকে নাকাল হতে হয় যাত্রীদের। সময়ে সময়ে পথচারীদের হেঁটে চলারও উপায় থাকে না।
এ সড়কের দুর্ভোগ ঘোচাতে প্রায় ২ বছর আগে একটি বাইপাস সড়কের নির্মাণ কাজ শুরু করে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর। তবে জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় থেমে যায় ওই সড়কের কাজ। সম্প্রতি ফের শুরু হলেও এলাকাবাসী কাজে ধীরগতির অভিযোগ করেছেন। সওজ কর্মকর্তারা বলছেন, বাইপাস নির্মিত হলে একরামপুর মোড়ের যানজট কমে আসবে।
একরামপুর তিন রাস্তার মোড়কে জেলা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থার ‘মূল পয়েন্ট’ বলে মনে করেন অনেকে। তারা বলছেন, মূল পয়েন্ট সচল থাকলে শহরের যান চলাচল ঠিক থাকবে। আবার মূল পয়েন্ট বিকল হলে পুরো শহরই হয়ে অচলাবস্থা অনিবার্য হয়ে পড়ে। একরামপুর মোড়ের যানজটের প্রভাব পড়ে পুরো শহরে। তখনই থমকে যায় পুরো কিশোরগঞ্জ শহর।
স্কুল শিক্ষিকা সুরাইয়া মনি ২৪ ঘন্টা বাংলাদেশ-কে বলেন, সবসময়ই শহরে ব্যাপক যানজট থাকে। ফলে বিশেষ করে চাকরিজীবি ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের খুবই কষ্ট হয়। তারা সময়মতো গন্তব্যে যেতে পারে না। শহরকে যানজটমুক্ত করতে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান।
একরামপুরের ব্যবসায়ী আলহাজ শেখ মো. আসাদুজ্জামান খোকন ২৪ ঘন্টা বাংলাদেশ কে জানান, শহরে অতিরিক্ত অটোরিকশা যানজটের একমাত্র কারণ। চামটা বন্দর থেকে একরামপুর হয়ে ঢাকাগামী বাসগুলো একরামপুর পয়েন্টে এলোপাথারিভাবে দাড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করায়। যার ফলে এই একরামপুর মোড়ে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকায় আমি এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীদের নির্বিগ্নে ব্যবসা পরিচালনা করা খুবই কষ্টসাধ্য।একরামপুরের অসহনীয় যানজটমুক্ত করতে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জোড় দাবি জানান। এদিকে শহর থেকে অবৈধ অটোরিকশা সরানোর দায়িত্ব পৌরসভার।
এ বিষয়ে পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড এর সাবেক কাউন্সিলর মো. সাইফুল ইসলাম ২৪ ঘন্টা বাংলাদেশ কে জানান, একরামপুরের যানজটের মূল কারণ হচ্ছে সতাল থেকে একরামপুর পযর্ন্ত রাস্তাটি ভাঙা থাকার কারণে,এখানে সবসময়ই যানজট লেগে থাকে। আর একটি বিষয় হলো পৌরসভা কর্তৃক অনুমোদিত অটোরিশার বাইরে অনুমোদনহীন অটোরিকশাগুলোর শহরের বাইরে স্যান্ড করা এখন সময়ের দাবী।
করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের গ্রামের বাড়ি থেকে জেলা শহরের খড়মপট্রি এলাকায় বোনের বাসায় যান জুয়েল মিয়া। তার ভাষ্য, একরামপুর থেকে খড়মপট্রি যেতে ৫-৭ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। কিন্তু যানজটের কারণে অধিকাংশ সময় এক ঘণ্টারও বেশি লাগে।
সতাল এলাকার মো. তাহের আলীর ব্যবসা রয়েছে একরামপুর। তিনি বলেন, পায়ে হেঁটে সতাল থেকে একরামপুর যেতে পাঁচ মিনিট লাগে, রেলস্টেশন গেলে লাগে প্রায় ৮ মিনিট। কিন্তু যানজটের কারণে এই পথটুকু যেতে কখনও কখনও ৪০-৫০ মিনিটও লেগে যায়।
একরামপুর মোড় হয়ে জেলার পূর্বাঞ্চলের করিমগঞ্জ, ইটনা, মিঠামইনসহ হাওরাঞ্চলের যানবাহনগুলো জেলা শহরে আসে। আবার জেলা শহর পেরিয়ে বহু যানবাহন ভৈরব-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে ঢাকা ও দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াত করে। বিপরীত দিকের বহু যানবাহন জেলার পূর্বাঞ্চলে যেতে হলেও এ মোড় ধরেই যেতে হয়। এই মোড় হয়েই যাতায়াত করতে হয় শহরের দক্ষিণ-পূর্ব কোনের রেলস্টেশন, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সদর উপজেলার দক্ষিণাংশ, নিকলী ও কটিয়াদী উপজেলারও অনেক এলাকায়। ফলে একরামপুর তিন রাস্তার এ মোড়টি জেলার যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ও জংশনের চরিত্র ধারণ করে আছে। এই মোড়ে যানজট হলে পুরো শহরই অচল হয়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বৃহদাকার ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ইটবোঝাই ট্রাক্টরসহ ছোটবড় প্রচুর যানবাহন ইঞ্জিন বন্ধ করে যানজটে আটকে আছে। ট্রাফিক পুলিশও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ভারী যানবাহন শহরে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একরামপুর যেন এর ব্যতিক্রম। ভারী যানবাহন শহরের দক্ষিণাংশের বত্রিশ, মনিপুরঘাট, সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি ও স্টেশন রোড হয়ে একরামপুরে চলে আসে। তখনই তৈরি হয় তীব্র যানজট। এ কারণে অনেক যাত্রীই ট্রেন ধরতে পারেন না। ট্রেনে ওঠার জন্য বাধ্য হয়ে অনেকেই মাঝপথে নেমে যান। লাগেজ-ব্যাগ মাথায় করে হেঁটে স্টেশনে যেতে বাধ্য হন।
পৌরসভা কর্তৃপক্ষ শহরে চলাচলের জন্য ৬৫০টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধন দিয়েছে। এর বাইরে প্রায় সমানসংখ্যক মিশুক আর ব্যাটারিচালিত প্যাডেল রিকশা চলাচল করে। ফলে সব সময়ই শহরে যানজট লেগে থাকে। একরামপুর মোড়ে যানজট থাকলে শহরের পরিস্থিতি দুর্বিসহ হয়ে ওঠে।
ইয়াকুব মিয়া ও তাহের মিয়া নামে দুই অটোচালক জানান, যানজটের কারণে তাদের আয়ও কমে যাচ্ছে। যে গন্তব্যে আগে আধা ঘণ্টায় তিনবার যাতায়াত করতে পারতেন, সেখানে এখন একবার যেতেই আধা ঘণ্টা লেগে যায়।
এ প্রসঙ্গে জেলা সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ২৪ ঘন্টা বাংলাদেশ কে জানান, একরামপুর হয়ে জেলার পূর্বাঞ্চল ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেসব যানবাহন চলাচল করে, সেগুলোর জন্য চওড়া বিকল্প সড়ক (বাইপাস) নির্মাণ করা হচ্ছে। সাত কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২৪ ফুট চওড়া এ সড়কের নির্মাণ ব্যয় ৭০ কোটি টাকা। তাহের লিমিটেড, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড ও রানা ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ নামে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে এর কাজ করছে। ২০২২ সালের জুনে শুরু হওয়া কাজটি ২০২৪ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো সম্পন্ন হয়নি। কাজটি শেষ হতে আরো বছরখানেক সময় লাগবে।বাইপাস সড়কের কাজ শেষ হলে সমস্যা কেটে যাবে বলে মনে করেন তারা।